কবি লিখেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ যে কোনো উন্নয়নে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের একার অংশগ্রহণে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় সব সময় অবহেলিত হয়ে আসছে! জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে যা-ই বলা হোক না কেন, নারীর অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। এখনো আধুনিকতার নামে নারীকে নানাভাবে পুঁজি করে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবার আগে দরকার সর্বক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন। গত কয়েক বছরে সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা, এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের ধারাবাহিক নারীবান্ধব কার্যক্রমের ফলে নারীর সমতার প্রশ্নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ।
সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান, তার নেপথ্যে নারীর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। সম্প্রতি এক তথ্যমতে, নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ এক দশকে ১৯ ধাপ এগিয়েছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৭২তম স্থানে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, শহীদ হয়েছে। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করে চলেছেন। নারীরা এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। রাজনীতি থেকে প্রশাসন সবক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে সমতার প্রশ্নে এখনো গুরুতর, জটিল ও পুরনো অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। নারীর প্রতি সমাজের নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারীরা নানাক্ষেত্রে সহিংস অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন। আবার তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার আইনি বিধান পেতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, ইভটিজিং, কুপ্রস্তাব ছাড়াও নারীদের ওপর নানা ধরনের সহিংসতা চলছে। পথে-ঘাটে চলাচলে বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের থেকে অপমানজনক কথার শিকার হতে হয়।
পরিবহনে নারীর নিরাপত্তার ব্যাপক অভাব রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নারীকে হেয় হতে হচ্ছে। এক তথ্যমতে, ৮৭ শতাংশ নারী নিজের ঘরেই নিগ্রহের শিকার আর গণপরিবহনে যৌন নিপীড়নের শিকার ৯৪ শতাংশ নারী। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে গুরুতর একটি সমস্যা হলো বাল্যবিবাহ। এর প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য, নিরাপত্তা ও সচেতনতার অভাব। ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৫৯ শতাংশ। সমতার দৃষ্টিভঙ্গির পথ প্রশস্ত হলেই নারীর এগিয়ে চলার পথ সুগম হবে। এক্ষেত্রে দরকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ, যা আমাদের সমাজকে সব ধরনের কুসংস্কার, অনাচার থেকে মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
নারীরা কোনো অংশে পুরুষের চেয়ে কম কাজ করেন না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেন। নারীর ঘর-সংসারে কাজের আর্থিক পরিমাণ নির্ণয় করে একে জাতীয় আয়ে নারীর অবদান হিসেবে উল্লেখ করার কথা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশে এখন আলোচনা হচ্ছে। সমতার প্রশ্নে নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সম-অধিকার চেতনায় পুরুষকে নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নারীকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সব বাধা দূর করতে হবে। নারীর অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে এগিয়ে নিতে পুরুষকেই ভূমিকা রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। নারীকে শুধু নারী-ই নয়, একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। তাই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সব ধরনের বৈষম্য রোধ করা সম্ভব হলে সমতার মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা