ধর্ম

সন্ত্রাস নয়, শান্তির ধর্ম ইসলাম

  • প্রকাশিত ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মুফতি উবায়দুল হক খান

 

সন্ত্রাস এমন একটি শব্দ যার প্রতি ঘৃণা, ধিক্কার ও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া চলছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর সংজ্ঞা ও স্বরূপ সম্পর্কে সর্বসম্মত ব্যাখ্যা আজও নির্ণীত হয়নি। যে কারণে দেখা যায়, যা একটি গোষ্ঠীর কাছে স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তা অন্যের ভাষায় চরম ধিকৃত বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস। কারো বক্তব্যে যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, অন্যের ভাষায় ঠিক তা-ই হলো আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা।

সন্ত্রাসের সর্বজনগ্রাহ্য একটি সংজ্ঞা নির্ধারণে চলছে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা। তবে সব কিছুর আগে আভিধানিক অর্থে সন্ত্রাস কি? সেটাই ভেবে দেখা দরকার। সন্ত্রাস শব্দ ত্রাস থেকে উদ্ভূত। ত্রাস হলো—ভয়, শঙ্কা, ভীতিকর। আর সন্ত্রাস হলো— আতঙ্কগ্রস্ত, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। সন্ত্রাসিত-সন্ত্রাসযুক্ত, সন্ত্রস্ত। সন্ত্রাস হলো কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা; অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি। সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য, অনুষ্ঠান, নীতি। আর সন্ত্রাসী যে বা যারা কোনো উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য শঙ্কা বা ভীতি সৃষ্টি করে। পারিভাষিক অর্থে সন্ত্রাস হলো-যে কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পথ বেছে নেওয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য সংঘবদ্ধভাবে ভয় দেখিয়ে বশ মানানোর নীতি অবলম্বন করা। সন্ত্রাসবাদী যে সন্ত্রাসবাদের আস্থাশীল বা তদানুযায়ী কাজ করে।

১৯৯৮ সালে এপ্রিল মাসে আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে সন্ত্রাস দমনে সম্মিলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে সন্ত্রাসবাদের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। ‘সন্ত্রাস হলো ব্যক্তি বা সামষ্টিক অপরাধ মনেবৃত্তির হতে সংঘটিত নিষ্ঠুর কাজ বা কাজের হুমকি, যে প্ররোচনা বা লক্ষ্যেই তা হোক না কেন, যা দ্বারা মানুষের মাঝে ভীতি সঞ্চার করা হয় বা তাদেরকে কষ্টে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বা তাদের জীবন, তাদের স্বাধীনতা, তাদের নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয় বা পরিবেশকে ক্ষতির মুখোমুখি করা হয়। অথবা প্রাইভেট বা সরকারি সম্পত্তি ছিনতাই করা, দখল করা, নষ্ট করা হয় অথবা কোনো রাষ্ট্রীয় উৎস ধ্বংসের মুখে ফেলা হয়।’

সন্ত্রাস নয়, শান্তি, সমপ্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মহান ধর্ম ইসলাম। বিশ্ব নিয়ন্তা কর্তৃক স্বীকৃত শান্তিপ্রিয় ধর্ম ইসলাম। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-‘আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম’। আর তিনি ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করতে বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেননা শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’। বিশ্ব প্রতিপালক মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে মানব ও জিন জাতিকে সৃজন করে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন। কোনো জিনিসের স্রষ্টা বা পরিচালক তার সৃজিত জিনিসের বিনষ্ট সাধন কোনো ক্রমেই চান না। যেহেতু স্রষ্টা কর্তৃক স্বীকৃত ধর্ম ইসলাম, বিধায় ইসলামই সর্বোৎকৃষ্ট এবং সর্বোত্তম পালনীয় ধর্ম এতে কোনোপ্রকার দ্বিধা-সংশয় নেই। তাইতো তিনি তাঁর মনোনীত ধর্ম পুরোপুরিভাবে মেনে চলার প্রতি বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে সাথে ইসলাম বহির্ভূত সকলপ্রকার ভ্রান্ত-শয়তানি পথ পরিহার করার প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সর্বজনবিদিত সৃজনশীল ধর্ম ইসলামে কোনো প্রকার জোর-জবরদস্তির সামান্যতম সুযোগ নেই। পবিত্র  কোরআনে ঘোষিত হয়েছে-‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি তথা জোর-জবরদস্তি করা যাবে না’।

যেসব উৎস থেকে সন্ত্রাস উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ লাভ করে তার মধ্যে জোর-জবরদস্তি তথা বাড়াবাড়ি অন্যতম উৎস। যেহেতু ইসলামে জোর-জুলুম বা বাড়াবাড়ির সামান্যতম সুযোগ নেই সেহেতু ইসলামে সন্ত্রাসেরও কোনো প্রকার সুযোগ নেই। ইসলাম সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদকে কোনো সময়ই প্রশ্রয় দেয়নি; বরং সন্ত্রাস উৎপত্তি ও বিকাশলাভের সকল উৎসকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি, দুরাচার, জিনা, ব্যাভিচার, খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, জুলুম, নিপীড়ন, জোর-জবরদস্তি, বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন ইত্যকার সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। আর ইসলাম এসকল অশালীন কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি; বরং এ সবের শাস্তি বর্ণনার পাশাপাশি এগুলো নির্মূলের চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সামান্যতম কৃপণতা প্রদর্শন করেনি।

ইসলাম সন্ত্রাসীভাবে তথা জোরপূর্বকভাবে কাউকে ধর্মান্তরিত করেনি। তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। ইসলামের মহান আদর্শ, উদারতা, মহানুভবতা, পরমতসহিষ্ণুতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই সকলে ইসলামের স্বর্গীয় সুধা পান করার গভীর প্রত্যাশায় দলে দলে ছুটে এসে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। ইসলামের নবী কর্তৃক পরিচালিত সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষা, প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধমূলক। কোনো একটি যুদ্ধও আক্রমণাত্মক ছিল না। পবিত্র  কোরআনে বিষয়টি এভাবে ঘোষিত হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদেরকে যুদ্ধ [কিতাল]-এর অনুমতি দেওয়া হলো যারা আক্রান্ত হয়েছে, কেননা তাদের ওপর জুলুম করা হয়েছে’। আরো বলেন—‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করো, কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’।

আয়াতদ্বয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে, ইসলাম স্রেফ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে। সাথে সাথে সীমালঙ্ঘন [সন্ত্রাস] করা থেকে বিরত থাকার প্রতিও কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ করেছিল এবং ভবিষ্যতেও একই কারণে অস্ত্রধারণ করবে। কিন্তু ইসলাম কোনো দিনই নৈতিক বিশ্বাস সংক্রান্ত মতবাদের সঙ্গে বিরোধিতায় লিপ্ত হয়নি। কখনো জুলুম করেনি। কখনো সরকারি তদন্ত স্থাপন করেনি। ইসলাম কখনো মতানৈক্যকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার কোনো উপায় উদ্ভাবন করেনি। মানুষের বিবেককেও গলাটিপে মারবার বা বিরুদ্ধ মতবাদকে নির্মূল করার কখনো কোনো চেষ্টা করেনি’।

উপরিউক্ত আলোচনা সামনে রেখে একথা দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই দৃঢ়কণ্ঠে বলা যায়, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের কোনো প্রকার দূরতম সম্পর্ক নেই; বরং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নির্মূল করে তদস্থলে সুখ ও শান্তি প্রিয় সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের মহান লক্ষ্যেই ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে। যারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত করতে চায় তারা নিছক অজ্ঞতা ও হীন স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যেই এরূপ হীনকর্মে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছে। তারা ইসলাম ধর্মকে জাতির নিকট প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন পরিকল্পনায় সদাব্যস্ত। তারা ইসলামের মহান আদর্শে ও মুসলমানদের নির্দোষ চরিত্রে সন্ত্রাসের কালিমা লেপন করে ইসলামের মর্যাদা, আদর্শ ও অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে দিতে চায়। তারা অন্যান্য বাতিল মতাদর্শের সাথে ইসলামী জীবনাদর্শকে তালগোল পাকিয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়।

অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শান্তির অগ্রদূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব কালীন সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যারা সদাসর্বদা ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করেছে, ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সদা ব্যপৃত থেকেছে, সকল প্রকার হীন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদ্ধতি অব্যহত রেখেছে; তারাই আজ ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম এবং মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। মুসলমানদের ক্ষতি সাধনই তাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সুতরাং একথা পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই; বরং ইসলাম শান্তি, সমপ্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মহানধর্ম। আল্লাহ আমাদের সকাল অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads