এক সময় পাট ছিল দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল এবং রপ্তানি পণ্য। সোনালি আঁশের স্বর্ণালি সম্ভাবনায় জাগরিত বাংলাদেশের এই পাটশিল্পের দুর্দিন গেছে গত চার দশক। দীর্ঘ সময়ে অনাদর, অবহেলা আর উত্থান-পতনের লড়াইয়ে নতজানু হয়ে পড়েছিল শিল্পটি। বন্ধ হয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী পাটকল। এরপরও দেখা গেছে বাংলার কৃষকরা নিজেদের ভালোবাসা থেকে আগলে ধরে রেখে পাট চাষ করেই যাচ্ছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব ফসল পাটের প্রতি কৃষকের এই ভালোবাসার লড়াইটির নাম পাটের লড়াই। এই আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকেও বাংলার কৃষকরা কৃষির ঐতিহ্যবাহী এই ফসলটির মর্যাদাকে হূদয়ে ধারণ করে আছেন। বলা যায় কৃষকের ভালোবাসার জোরেই চার দশক পর আবারো সগৌরবে ফিরে আসতে শুরু করেছে পাটশিল্প। ৬ মার্চ ছিল জাতীয় পাট দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আমাদের কৃষি ও অর্থনীতি পাতার বিশেষ আয়োজনে বিস্তারিত জানাচ্ছেন- এস এম মুকুল
পরিবেশের সাথে পাট চাষের নিবিড় বন্ধন। পাটের পরিচয় অর্থকরী ফসল হিসেবে হলেও এখন পরিবেশ সহায়ক হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারকে সারা বিশ্বে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে পাট চাষে পরিবেশের উপকারী দিকগুলোর কথা। আর এ কারণে একজন পাটচাষির পরিবেশ রক্ষায় অবদানের কথা বিবেচনায় আসছে না। এমনকি যিনি পাটের আবাদ করছেন তিনি নিজেও জানেন না যে, তিনি কেবলই অর্থকরী ফসল হিসেবে নয়, পরিবেশের সহায়ক অসামান্য অবদান রাখছেন। আমরা কেবল পাটের অর্থকরী অবদানের দিকটিই জানি। তবে পাট গাছ যে অর্থকরী, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী একটি ফসল সেই কথা অনেকেরই হয়তো জানা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসলটি নির্মল বাতাস সৃষ্টির অন্যতম কারিগর। কারণ পাট গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে, যা আমরা ত্যাগ করি এবং প্রচুর অক্সিজেন ত্যাগ করে যা আমরা গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। পাট গাছের ক্ষেত্রে আছে অনেক ব্যতিক্রম অবদান, যা ফসলি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে করে সমৃদ্ধ। পাট একটি জলবায়ু সহনশীল ফসলও বটে। কারণ সাময়িক খরা কিংবা জলাবদ্ধতায় পাট ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। পাট সবুজ বৃক্ষ এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের নিজস্ব উপাদান। পাট উৎপাদনে খুবই কম পরিমাণের সার প্রয়োজন হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে, আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়। পাটজাত দ্রব্য সহজে মাটিতে মিশে যায় বলে প্রক্রিয়া করা পাটজাত দ্রব্যও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। অপরদিকে বিশ্বে প্রতি বছর এক ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার ১০ লাখেরও বেশি পাখি এবং লক্ষাধিক জলজ প্রাণী। পলিব্যাগের বদলে পাটজাত দ্রব্য ও মোড়ক ব্যবহার হলে আমরা পরিবেশকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে মানবজাতির উপযোগী করে তুলতে পারি।
জলবায়ু সহনশীল ফসল
পাট বৃষ্টিনির্ভর ফসল। পাট চাষ থেকে পশুখাদ্য ও সবজি পাওয়া যায়। ঘন ও উঁচু ফসল হওয়ার কারণে পাট বনভূমির মতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল হিসেবে একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতির মাঝে নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পাট ফসলের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটার জায়গায় ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। তার চেয়েও বড় ব্যাপারটি হলো, পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিনহাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।
পরিবেশ সহায়ক জ্বালানি পাটকাঠি
পাটখড়ি পাট চাষের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ পাটখড়ি উৎপাদিত হয়। ঘরের বেড়া, ছাউনি এবং জ্বালানি হিসেবে খড়ির ব্যবহার সর্বাধিক প্রাচীনতম। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিক্যাল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটখড়ি ব্যবহূত হয়। জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পাটকাঠির ব্যবহার যত বাড়বে গাছ কেটে বন উজাড় করার প্রবণতা তত কমবে। সাথে আরো লাভ হবে, বৃক্ষ পরিবেশকে মানুষের জন্য বাস উপযোগী করে তুলবে। বৃক্ষের ফল, ফুল মানব জাতিকে পুষ্টি ও ঔষধি উপকরণ জোগাবে। কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড় আর পশুপাখির নিরাপদ বাসস্থান হবে বৃক্ষ। তাহলে জ্বালানি হিসেবে পাটকাঠির ব্যবহার পরিবেশের জন্য সহায়ক।
মাটির উর্বরতা শক্তি ও গুণগত মান বাড়ায়
পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে, যা মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। আরো সহজভাবে বলতে পারি, যে জমিতে পাট চাষ হয় সে জমিতে অন্য ফসলও ভালো হয়। কীভাবে তাই বলছি। পাট ফসল উৎপাদনকালে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা ঝরে গিয়ে মাটিতে যোগ হয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাটপাতা ও ৪২৩.৪০ হাজার টন পাট গাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। পাট গাছের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে। এই পাট মূল মাটির গভীর থেকে অজৈব খাদ্য উপাদান মাটির ওপরের স্তরের সাথে সংমিশ্রণে সঞ্চালকের ভূমিকা রাখে। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে ও মাটিতে পানি চলাচল সহজ এবং স্বাভাবিক থাকে। এ ছাড়া ফসল কর্তনের পর জমিতে থেকে যাওয়া পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় পচে মাটির সাথে মিশে জৈবসারে পরিণত হয়। এর ফলে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। আবার পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ এবং জাগের ও ধোয়ার তলানি, পাট পচা পানি উৎকৃষ্ট জৈবসার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। পাট জাগ দেওয়ার সময়ে সেখানে মাছের উত্তম খাবার মেলে। মাছ তা খেয়ে দ্রুত বাড়ে।
সচেতনতায় বাড়ছে সুযোগ ও সম্ভাবনা
পাটের পরিবেশবান্ধব বহুমাত্রিক ব্যবহার বিশ্বে দিনদিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব মনোভাব নিয়ে সচেতন ভূমিকায় পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহার বাড়ছে। পাটের ব্যবহার হয়ে থাকে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদিতে। পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট ইত্যাদি পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সাথে পাটের মিশ্রণ করা হয়। কৃষিপণ্য এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি। জানলে অবাক হবেন, বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাল্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল, হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্কিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিকস, মেরিন ও স্কোর্টস শিল্পে ব্যবহূত হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপের বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, ওডি ফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের জিএম মোটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্কানিসহ নামিদামি সব গাড়ি কোম্কানিই তাদের গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডব্লিউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশসম্মত ‘গ্রিন কার’ যার চাহিদা এখন প্রচুর। পাটপণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান পণ্য পাটের বস্তা অনেক দেশে ধান সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় রাস্তার মাটি ক্ষয় রোধে, নদীভাঙন রোধে ব্যবহার করা হয়েছে। পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল। জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহূত হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, রেল, সড়কসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অবকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে জিওটেক্সটাইলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে নানা কাজে ‘মেটাল নেটিং’ বা পলিমার থেকে তৈরি সিনথেটিক জিওটেক্সটাইলের পরিবর্তে পরিবেশ উপযোগী ও উৎকৃষ্ট জুট জিওটেক্সটাইলের কদর বাড়ছে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক