শুদ্ধতম রাজনীতিকের আদর্শ

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

শুদ্ধতম রাজনীতিকের আদর্শ

  • মো. আসিফ উল আলম সোহান
  • প্রকাশিত ৭ জানুয়ারি, ২০১৯

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন কিশোরগঞ্জের সংসদ সদস্য অথচ হওয়ার কথা ছিল ব্রিটেনের লেবার পার্টির এমপি। ’৯৬ সালে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন শেখ হাসিনা, তারপর একাধারে ২২ বছর পার্লামেন্টারিয়ান। এক মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী, দুই মেয়াদে মন্ত্রী। আপাদমস্তক বই পড়ুয়া, প্রযুক্তিপ্রেমী আর কর্মীবান্ধব লোক ছিলেন তিনি। যে ওয়েস্ট মিনস্টার ডেমোক্র্যাসির তিনি ভক্ত ছিলেন সেটা সম্পূর্ণ না হলেও তার কিছুটা চর্চা তিনি করে গেছেন ঠিকই। দলের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন তিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের হাতে। স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন— ক্যামেরাবাজির বাইরেও সেক্রেটারির অনেক কাজই থাকে। বাকি তিনজন কেন আছে?  সৈয়দ আশরাফের সততার প্রমাণ মেলে তিন মেয়াদে মন্ত্রী থাকার পরও যখন তার সম্পদের পরিমাণ কমে যায়। এসব তার হলফনামা, ট্যাক্স রেকর্ডই সাক্ষ্য দেয়। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। ভারতের জেনারেল মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তর নিয়ে তার বইতে যে সাদামাটা, শান্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যোদ্ধা আশরাফের কথা বলেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের এই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও, শুকনো রুটি খেয়ে যুদ্ধ করেছেন বন্দুক হাতে মাটিতে বুকে ভর দিয়ে। সেই সৈয়দ আশরাফ ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর বাবার মৃত্যুর পর বিলাতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে লেবার পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। শেখ হাসিনার নির্দেশে সে-সময় এমন এক এলাকায় নৌকার জয় ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই কিশোরগঞ্জের আসনে, রানিং এমপি ছিল আল বদর তাত্ত্বিক নেতা আতাউর রহমান খান, যে কি না খালেদা জিয়াকেও পরোয়া করত না। তারপর, সৈয়দ আশরাফ ৯৬ সালে এসে বিমান প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর শেখ রেহানার স্বামী ডক্টর শফিক সিদ্দিকী তার এক লেখায় বলেছিলেন— কীভাবে বিপর্যস্ত জিল্লুর রহমান শেখ রেহানাকে দিয়ে অনুরোধ করিয়ে সৈয়দ আশরাফকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে রাজি করিয়েছিলেন।  সেদিন এই দুজনের জন্য বেঁচে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তারপর সেই সৈয়দ আশরাফ কেমন করে ৫ মে জেহাদী বিপ্লব থেকে ঢাকা শহরকে বাঁচিয়েছিলেন।  তিনি কেমন সৎ, কত উঁচুতে তার ভাবমূর্তি; কেমন সজ্জন— এগুলো নিয়ে অনেক কথাই আলোচনা হচ্ছে। এই ফাঁকে আমি আরো দুটো তথ্য দিয়ে রাখি— ‘আমি হিন্দুও নই, মুসলিমও নই’— সৈয়দ আশরাফের খণ্ডিত একটা বক্তব্য। যেটা ২০১১ সালে সোনার বাংলা ব্লগে বিকৃত আকারে এসেছিল। দুই বছর পর ২০১৩ সালের ৫ মে তার সাহসিকতায় গুটিয়ে যাওয়ার পর হেফাজতে ইসলাম ওই বক্তব্যটা লুফে নেয়, নতুন করে তাকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করে। পুরো ঘটনাটা হচ্ছে— ২০১১ সালে সরকারি বাসভবন পদ্মায়, ওইদিন ১১টি ইসলামী দলের নেতৃত্বে হরতাল পালিত হয়েছিল সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম থাকার বিষয়ে। ওই দিন দেশের সবগুলো পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন— ‘কমিটি যদিও রাখতে চাইছে; কিন্তু তিনি ছাড়াও সংবিধান সংশোধন কমিটির কয়েকজন সদস্য এই রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘সংবিধান তো দেশের সব নাগরিকদের জন্যই। সংবিধান যখন পড়ব তখন আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না, আমি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটা পড়ব এবং এইটা মান্য করব’। এটাই ছিল তার বক্তব্য। এ কথাকেই এখন মাঝামাঝিতে বিকৃত করা হচ্ছে। একটা মৃত মানুষের নামে বিকৃত করে কুৎসা রটাচ্ছে।

সৈয়দ আশরাফ ছিলেন আপাদমন্তক অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। একজন জাজ্বল্যমান নক্ষত্র ছিলেন তিনি। সৈয়দ আশরাফের কর্মস্থল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় একটা ঘটনা তুলে ধরছি— ২০১৬ সালে যেটা অনেক পত্রিকায়ও এসেছিল। সে-সময় সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭৩ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দেয়। এর মধ্যে ২১ জনকে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স নেই, এই অভিযোগে প্রমোশন বঞ্চিত রাখা হয়। সোজা কথা, সরকার যাদের মনে করেছে আনুগত্য নেই, ‘হার্ডকোর আওয়ামী লীগার’ নয় তাদের প্রমোশন আটকে দেওয়া হয়েছিল। দেশে ফিরে এই অনিয়মের কথা শুনে সবার প্রমোশনে সাইন করা থেকে বিরত থাকেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নির্দেশে, এসএসবি সুপিরিয়র কমিটি এটা করেছে। তার পরও, সৈয়দ আশরাফ নিজের আপত্তি দিয়ে বলেন, প্রমোশনের ক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার সার্ভিস রুল তিনি তার মন্ত্রণালয়ে চালু করবেন এবং কোনো অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব তিনি বরদাশত করবেন না। এরপর বাদ পড়া এবং অনিয়মের শিকার সবাই প্রমোশন পান, সৈয়দ আশরাফের সততার কল্যাণেই। এই নিউজটা সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছিল। তখন অনেকেই খুনসুটি করে তাকে বলতেন বেশি ভালো, ভালো না। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ দেখিয়ে গেছেন ভালো সে তো ভালোই। সকল ভালোই শুভ্র আলো ছড়াতে জানে। স্ত্রীর দুরারোগ্য ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বনানীর বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি, তবুও সরকারি কোনো সহযোগিতা গ্রহণ করেননি। 

বাংলাদেশের রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে বড্ড প্রয়োজন ছিল সৈয়দ আশরাফের মতো একজন রাজনীতিককে। রাজনীতির যে মাধুর্য তিনি ছড়িয়ে গেছেন কিশোরগঞ্জের নিজ এলাকায়, সেই মাধুর্যে বশবর্তী হয়ে আজ রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক প্রক্ষাপটেও নিজ এলাকার ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষও তার বিয়োগে অশ্রুসিক্ত হচ্ছে বার বার। দেশের রাজনীতিতে এরকম সৎ নিষ্ঠাবান বংশীয় আদর্শিক মানুষের বড় অভাব।

পৃথিবীতে খুব কমই আছেন এমন নির্লোভ মানুষ, যে কি না সকল ধর্ম আদর্শের ওপরে উঠে শরীরের নীল রক্তের মর্যাদা দিতে জানে। হয়ে উঠতে পারেন সকল দলের, সকল ধর্মের আর সমগ্র জাতির সর্বজন শ্রদ্ধেয়। নেতা, বিনম্র শ্রদ্ধা আপনার রেখে যাওয়া আদর্শের প্রতি।

 

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবর

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads