শিগগির হচ্ছে না তিস্তা পানিচুক্তি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফরেও সুসংবাদ নেই

শিগগির হচ্ছে না তিস্তা পানিচুক্তি

  • মো. রেজাউর রহিম
  • প্রকাশিত ৩ মার্চ, ২০২০

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে আপাতত কোনো সুসংবাদ নেই। শিগগির এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা ভারতের বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এর আগে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয় এবং স্থল ও নৌপথে বাংলাদেশ থেকে ভারত বহুমুখী যোগাযোগ সুবিধা পেলেও বিনিময়ে তিস্তার পানিবণ্টনে কোনো সুরাহা এখন পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে হয়নি। এমনকি তিস্তার পানি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কবে চুক্তি হবে কেউ জানে না।

জানা গেছে, গত অক্টোবর মাসে ভারত সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের অনাগ্রহের কারণে ইতিবাচক আলোচনা হয়নি। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি নিয়ে ২০১১ সালের একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোর কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিলেও অতীতের অজুহাত দেখিয়ে তখন দায় সারেন নরেন্দ্র মোদি। তবে বিষয়টি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধার মুখে বেশ কয়েকবার দেশটির সঙ্গে আলোচনা হলেও তা চূড়ান্তভাবে কোনো চুক্তিতে পৌঁছায়নি। তবে ওই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দু’দেশের সরকার অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোর বিষয়ে একমত হয়েছিল। এই চুক্তির বাস্তবায়ন  দেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বলেও তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছিলেন।

তখন নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তি যাতে দ্রুত সম্পাদন হয় সে লক্ষ্যে বিজেপি সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের কর্তৃপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কোনো দেশই।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার বিকল্প হিসেবে অন্য নদীর পানি নিয়ে আলোচনা তথা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বাস্তবে সেসব প্রস্তাবও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আর তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আড়ালে থাকলেও দুই দেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাতটি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় একটি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তিস্তার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে এ কাঠামো অনুসরণ করা হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি আছে শুধু গঙ্গা নিয়ে। সেই গঙ্গা চুক্তিতেও ন্যায্যতা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এ পরিমাণ পানি কোনো বছরই পায়নি বাংলাদেশ। কোনো কোনো বছর মাত্র দেড়-দুই হাজার কিউসেক পানিও পেয়েছে বাংলাদেশ। আর তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে পাঁচ দশক ধরে।

এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরকালেও তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে কোনো সুসংবাদ নেই। তবে সফরকালে গতকাল সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা এ চুক্তির বিষয়ে কাজ করছি। তিস্তাসহ আমরা অন্য নদীর পানিবণ্টনের বিষয়েও আলোচনা করছি, যাতে উভয় দেশের মানুষ উপকৃত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে তিনি দুদিনের সফরে গতকাল ঢাকায় পৌঁছেন। হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ভারত তিস্তা নদীর পানি চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একমত হয়েছিল এবং এ অঙ্গীকার থেকে সরে যায়নি। তিনি বলেন, ভারতের ফেডারেল সিস্টেম অনুযায়ী, যেসব প্রদেশের সঙ্গে যৌথ নদী বিদ্যমান, তাদের সঙ্গে একমতের ভিত্তিতে এ ধরনের চুক্তি করতে হয়। বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। গত আগস্টে সাতটি নদীর পানি প্রবাহের তথ্য নিয়ে আলোচনার কথা উল্লেখ করে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ তথ্যের মাধ্যমে দুই দেশের একমত হওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে। তিনি বলেন, আমি আশ্বস্ত করতে চাই তিস্তাসহ কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। যে কোনো ধরনের সরাসরি অথবা সরাসরি নয় এবং ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। তবে তিস্তাসহ দু’দেশের মধ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ধীরগতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এ সমস্যার সুরাহা না হলেও বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমে মাঝে মাঝেই খবর বের হয় ‘শিগগির তিস্তাচুক্তি হচ্ছে’। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এ-জাতীয় খবর প্রকাশিত হয় সাধারণত ভারতের পক্ষ থেকে নতুন কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও তা বাংলাদেশের অনুমোদনের প্রয়োজন হলে। আর ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়টি অনুমোদন হওয়া মাত্র তিস্তার পানিচুক্তির বিষয়টি আবার হিমাগারে চলে যায়। এছাড়া আসন্ন শুষ্ক মৌসুম বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে সেচের পানি পাওয়া নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর পানি না দেওয়ার ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা তৈরির জন্য ভারতের প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলী প্রচারণা চালিয়েছে। ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুক্তি না করার বিষয়ে অনড়’ এমন প্রচার কৌশল নেওয়া হয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বাস্তবে নরেন্দ্র মোদি এবং এর আগে মনমোহন সরকার ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করলেও কোনো রাজ্যসরকার বা মুখ্যমন্ত্রী এসব চুক্তির ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তুলেছেন- এমন নজির না থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তির কথা উঠলেই তখন দিল্লির রাজনৈতিক অঙ্গীকারের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে নানা অজুহাত, আপত্তি ও বাধা।

পররাষ্ট্র বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এসব কৌশলী অবস্থানের কারণেই দীর্ঘদিন ঝুলে আছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। এর আগে চুক্তি হওয়ার মতো অবস্থা যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো ‘বাড়তি জল’ নেই এবং ‘নতুন সমীক্ষা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি নিয়ে কোনো চুক্তি করা যাবে না’ বলে প্রচার চালায়। অথচ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে করিডোর পাওয়ার আগে ২০১১-এর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা চুক্তির জন্য ‘প্রয়োজনে মমতার একগুঁয়েমিকে অগ্রাহ্য’ করে হলেও এ চুক্তি বাস্তবায়ন হবে এমন কথা বলেছিলেন। তবে বাস্তব অবস্থা হলো, বাংলাদেশের কাছ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়ার পর থেকেই তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি সুরাহা না করে দেশটি নানা টালবাহানা করছে।

এদিকে ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবরই দু’দেশের গভীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে। আর তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে না পারাটা দুই দেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতারই নামান্তর। আর তিস্তার পানি পাওয়ার আশায় বাংলাদেশ গত এক দশকে ভারতের চাহিদামতো সব সুবিধাই দিয়েছে বলা যায়। কিন্তু এর আগে মোদির সফরকালের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত পঞ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আপত্তি’র কথা বলে তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টনে সফল চুক্তি হলেও ভারতের একগুঁয়েমির কারণে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তিটি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads