মুক্তমত

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য

  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর, ২০২০

আরাফাত শাহীন

 

 

আমাদের দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে এখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অসংখ্য পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন সেটা বাস্তবায়িত হলে দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় যে ব্যাপক গতির সঞ্চার হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার পাঠ শেষ করে বের হয়ে আসছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখকর একটা বিষয়। তবে এখানেও একটা কথা থেকে যাচ্ছে। আমরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের আচরণে এই শিক্ষার কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে? আমাদের আচার-আচরণে যদি শিক্ষিত মানুষের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে তাহলে সেই শিক্ষা কি দেশের জন্য ফলপ্রসূ হবে?

শিক্ষা আসলে কী? শিক্ষা হলো তাই যা মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করে। মানুষের ভেতর একটা ‘মানুষ’ বাস করে। শিক্ষা সেই ভেতরের মানুষটাকে টেনে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে। আমরা মনে করি, যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে পাস করে বের হয়ে আসেন তারাই বোধহয় প্রকৃত শিক্ষিত! আর যারা কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি তারা বোধ হয় শিক্ষিত নন। এই ধারণা থেকেই হয়তো আমরা জগতের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে অশিক্ষিতের কাতারে ফেলে দেই। শুধু তাই নয়, আমাদের সমাজের অনেক পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান ব্যক্তিকে দেখেছি সমাজের শ্রমজীবী মানুষের সাথে নির্মম আচরণ করতে। তখন আমার মনে সত্য সত্যই প্রশ্ন জাগে, আসলে প্রকৃত শিক্ষিত কারা।

একটা উদাহরণ টেনে বলি, তখন সবেমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করে। একদিন বন্ধুকে নিয়ে চারুকলা অনুষদের ওদিকে খেতে গেলাম। খাবার সময় তর্কাতর্কির আওয়াজ পেয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক রিকশাওয়ালার সঙ্গে তর্ক করছেন। সম্ভবত ভাড়া নিয়েই তাদের মধ্যে সমস্যার সূত্রপাত। একপর্যায়ে ভদ্রলোক রিকশাওয়ালাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বললেন, জানিস আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার।  রিকশাচালক কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হলো আমি যেন মাটির সাথে মিশে  গেছি।

আমার কথার মানে এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই বুঝি খারাপ। এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহার মতো শিক্ষক আছেন, যিনি পাকিস্তানি সেনার সামনে বুক পেতে দিতে পারেন, সে দেশের সব শিক্ষক খারাপ হতে পারেন না। তবে যখন আমরা দেখি, আমাদের এই পথপ্রদর্শকরা অন্যের গবেষণা চুরি করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন, নিজেদের মধ্যে দলীয় কোন্দলকে প্রকাশ্যে টেনে আনেন, নিজেদের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার করেন, তখন আমরা হতাশ না হয়ে পারি না।

আমরা আসলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বহুদূরে সরে এসেছি। সমস্যাটা মূলত এজন্যই সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা। কিন্তু শিক্ষা এখন হয়ে উঠেছে কেবল চাকরি লাভের উপায়। অবশ্য আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা সেদিকে অগ্রসর হতেই প্ররোচিত করছে। আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন শিক্ষার পরিবেশ ঠিক কতটুকু বিরাজমান, আমরা সেটা নিয়ে সন্দিহান। অসুস্থ ছাত্ররাজনীতি আমাদের শিক্ষার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে প্রতিনিয়ত। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো মাদকের ভয়াল থাবায় আজ ক্ষতবিক্ষত। এটা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে শুভ ফল বয়ে আনবে না। 

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার চর্চা একেবারেই হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষা আসলে আজকাল সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। তা না হলে নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট বিক্রি হবে কেন! সার্টিফিকেট দেখে আমরা যখন শিক্ষার মান বিচার করি তখন শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যখন দেশ, জাতি এবং সমাজকে নিয়ে না ভেবে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে থাকে তখন সেটা জাতির জন্য কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বয়ে আনে। প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েট পাস করে এখন বেকার বসে আছে। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আমাদের প্রকৃত মানুষ হতে হবে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যখন আমাদের বুকে জাগ্রত করা সম্ভব হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতার চর্চা শুরু হবে সেদিনই প্রকৃতপক্ষে আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। নীতি-নৈতিকতাহীন একটা জাতি কখনোই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না।

 

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

smshaheen97@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads