মীম মিজান
বেশ কিছুকাল আগে একটি জাতীয় দৈনিকের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল-‘বই ও পরীক্ষার চাপ কমাতে বললেন শিক্ষাবিদরা’। খবরটি পড়ে আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। শিক্ষাবিদদের এই সুপারিশ যদি বাস্তবায়ন হয় তবে জাতির ভবিষ্যৎ সম্পদরা তাদের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের শিক্ষাজীবনের গণ্ডি পেরুতে পারবে স্বাচ্ছন্দ্যে। হায়রে শিক্ষা, হায়রে পুস্তকের বোঝার থলে, হায়রে নিত্যসঙ্গী পরীক্ষা!
আমরা দৈনিক খবরের কাগজ ও টিভি মাধ্যম থেকে জানতে পারি শিক্ষার্থীর স্কুলের ব্যাগ ভীষণ ভারী। একজন শিশু তার শারীরিক ভার বহনের যে ক্ষমতা রয়েছে তার চাইতেও বেশি ওজনের বই বহন করতে হয় তাকে। এতে করে ওই শিক্ষার্থীর শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অনেক শিশুই বিরক্ত হচ্ছে শিক্ষার প্রতি।
স্কুলের পরীক্ষার শেষ নেই। সাপ্তাহিক, মাসিক, দ্বি-মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বাৎসরিক ইত্যাদি পরীক্ষা তো কোমলমতি এই শিশুদের তাড়া করে বেড়ায়। এ ছাড়াও একজন দশ বছরের শিশুকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি পাবলিক পরীক্ষা নামক পরীক্ষাযজ্ঞের মধ্যে। সারা বছর পড়াশোনা, ক্লাস, কোচিং ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। শুক্রবার একটি ছুটির দিন সেদিনও কোচিংগুলোতে চলে পরীক্ষা আর পরীক্ষা।
এভাবে প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা এরকম সারা বছরই চলছে দেশব্যাপী পাবলিক পরীক্ষার মহড়া। অধিকন্তু শিশুদের দেওয়া হচ্ছে চৌদ্দটি-পনেরোটি করে বিষয়। আহা! কোমলমতি বাচ্চারা হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ফর্মূলা (!) বাস্তবায়নের ক্ষেত্র।
পরীক্ষার মানসিক চাপ, স্কুলের ভারী থলে বহন, চৌদ্দটি-পনেরোটি বইয়ের পাঠ শেষ করা, স্কুল থেকে কোচিং, কোচিং থেকে বাসায় হাউজ টিউটর—এভাবে প্রায় সারাটা দিন যজ্ঞের মধ্যে ব্যস্ত থেকে সে যে নিজের মননবৃত্তি বা খেলাধুলা করবে সেই সময় কোথায়? এত পাহাড়সম বোঝা নিয়ে বছর শেষে যখন পরীক্ষায় বসবে তখনই অযোগ্য-অসৎ কর্মকর্তার মাধ্যমে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্ন। দশ বছরের এক শিশুর বোঝারই কথা নয়, প্রশ্ন ফাঁস কি? বা নকল করা কি? অথচ তারাই এই ফাঁসকৃত প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকে। কয়েক বছর আগে এক প্রাথমিক সমাপনীর গণিত পরীক্ষার আগের রাতে আমার কাছে এলাকার পাঁচজন সমাপনী পরীক্ষার্থী এসে বলছে, ‘স্যার, আপনি তো ফেসবুক চালান ও সবকিছুর খোঁজ রাখেন। ফেসবুক থেকে আমাদের একটু প্রশ্ন বের করে দিন না!’ কী ভয়ানক একটি মানসিকতা তারা ধারণ করে আছে ভেতরে ভেতরে! পরীক্ষার আগের রাতে এসে প্রশ্ন সংগ্রহ করতে চায় এই দশ বছরের কিশোররা।
আমি আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি, যা শুনলে অনেকেই উপলব্ধি করতে পারবেন কী সাংঘাতিক অবক্ষয় ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীদের! আমি তখন মাধ্যমিকে পড়ি। এলাকায় খুব কম দূরত্বে অনেকগুলো মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে দুয়েকদিন আগে পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে। আমার এক সহপাঠী সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন অগ্রিম সংগ্রহ করে এনেছে। সেই প্রশ্ন নিয়ে তুমুল হারে পড়াশোনা করেছে এবং সাদা পাতায় লিখেও নিয়েছে সেসব প্রশ্নের উত্তর—উদ্দেশ্য পরীক্ষার হলে প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহকৃত উত্তরপত্রের মাঝখানে যুক্ত করে দেবে বলে। সেই সহপাঠীর বাবা তার ছেলের এই চৌকস কর্মদক্ষতা দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। আর বলেছিলেন, এই প্রশ্ন থেকে দু-একটি কমন পড়লেও লাভ। সেই সহপাঠীটি মাধ্যমিক পেরোতে পারেনি। মাধ্যমিকের নির্বাচনীতে ছাঁটাই হয়েছিল। সে এখন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
একটু পেছন ফিরে যদি তাকাই তাহলে আজ থেকে বিশবছর আগের সময়কার শিক্ষা-দীক্ষার অবস্থা জানা যাবে। আমরা সেসময়টাতে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতাম। ঘন্টা দুয়েক পড়ার পর খেলাধুলা করতাম। প্রায় একঘন্টা খেলাধুলার পর গোসল করে খেয়ে দেয়ে বিদ্যালয়ে যেতাম। বিদ্যালয়ে দুপুরে একঘন্টা বিরতির সময় সোৎসাহে চলত খেলা। বিদ্যালয় প্রায় বিকেল চারটার দিক ছুটি হতো। বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে মাঠে দৌড়। সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে তিন ঘণ্টার মতো পড়তাম। এভাবে পড়াশুনা করে সে সময়ে আমরা পেতাম বৃত্তি। বোর্ডে মেধাস্থানও অধিকার করতাম।
আরো আগে যদি ফিরে যাই ঠিক একই রকম চিত্র দেখতে পাওয়া যাবে। প্রচুর পরিমাণে খেলাধুলা করার ফুসরত ছিল। এ রকম ফুসরতসহ সে সময়ে জন্ম হয়েছিল জিসি দেব, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল, ড. জামাল নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ। গ্রামের পল্লী এলাকা থেকে উঠে এসেছিল ড. আতিউর রহমানের মতো ব্যক্তিত্বগণ। তবে কী তারা আলাদীনের চেরাগ পেয়েছিলেন সে সময়ে? না আলাদীনের চেরাগ পাননি তারা। নিজেদের মেধা, শ্রম, মনন দিয়ে তারা নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
অনেকেই খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করান যে, বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে এরকম টাইট শিডিউলের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করতে হয়। এই মহাজনগণ নিচের বিষয়গুলো খেয়াল করে দেখেন কিনা? প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থী শারীরিকভাবে অসুস্থ। কেউ স্থূল, কেউ বা শীর্ণ। কারো রুচি নেই খাওয়াতে। রোদের তাপ একটুও সহ্য করতে পারে না। একশ মিটার দৌড় দিলে স্যালাইন পুশ করতে হয়। চোখে কম দেখে। পড়াশোনায় অনীহা ইত্যাদি।
এসবের পিছনের কারণ অনুসন্ধান করলে উত্তর আসে তারা খেলাধুলা করে না। স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কম্পিউটারে গেম খেলে। স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ব্রয়লার মুরগির ফার্মের মতোই আটো-সাটো। পরীক্ষা আর পরীক্ষা। অনেকগুলো বই। অপ্রয়োজনীয় চাপ আসে শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। বছর বছর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ফলাফল ভালো করে কিন্তু খেলাধুলায় তারা ভীষণ অনীহা দেখায়। তা সত্ত্বেও আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকগণ খুশি। একবারও খেয়াল করা হয় না তাদের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধির দিকে। শ্রেণির প্রথমস্থান অধিকারের তকমা। বোর্ড পরীক্ষার সোনালী পয়েন্ট। বাহ্ কী সফল আমরা!
কারিকুলামেও অতিরিক্ত বইয়ের চাপ। জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা এ রকম কয়েকটি অতিরিক্ত বই দেওয়া ছিল সিলেবাসে। এগুলোর পরীক্ষা দিতে হতো বাচ্চাদের। কেজি স্কুলগুলোতে তো বয়সের তুলনায় উচ্চমানের বই পড়ানো হয়। স্টান্ডার্ড ওয়ানে পড়ুয়া ছাত্রকে পড়ানো হচ্ছে ছয়টি বই। তিনবছর বা তিনবছর ছ'মাসের একটি অবুঝ শিশুকে সকাল বেলা জোর করে ঘুম থেকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছি কেজি স্কুলে। এই স্কুলগুলো কী একটু পরে শুরু করা যায় না? সকাল নয়টায় কিংবা তারও পরে। আর এই তিন বা তিনবছর ছ'মাসের শিশুটির উপরই বা আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি কেন এত বইয়ের বোঝা?
আমার দশম শ্রেণি পড়ুয়া এক ভাইজির কথা না বললেই নয়। ক্লাসের প্রথম রোলটি ছিল তার। পিএসসি ও জেএসসিতে মেধাক্রমে বৃত্তিধারী সে। তার বাবা তাকে সারা দিন প্রায় পড়ার মধ্যেই ডুবে থাকতে বলতো। একটু এদিক-সেদিক হলে শাসন ও বকাঝকায় ত্রস্ত করে তুলতো। সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে, সেই মেধাবী ভাইজি মানসিক রোগী হয়ে গেল। আবোলতাবোল বকে। মাথাব্যথায় পীড়িত থাকে অধিক সময়।
এসবের কী কোনো সমাধান নেই? শিক্ষার্থীরা কেন নেই খেলার মাঠে? সময় পেলেই মাথা ঝুঁকে পিসি, ট্যাব বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে পড়ে থাকে? কেন তারা আজ শারীরিকভাবে সুঠাম নয়? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীর মেধা ও মননকে কীভাবে জাগিয়ে তোলা যায়। মুখস্থের পুতুল না গড়িয়ে তাদেরকে তাদের মতো বেড়ে ওঠার একটা সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। আজ এরকম সহনীয় ও স্বাচ্ছন্দ্যময় একটা শিক্ষার পরিবেশ ও ব্যবস্থার বড্ড প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক
meemmizanru@gmail.com