আমজাদ হোসেন হৃদয়
করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো বিশ্বে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাকি সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচল থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় ভুগছেন এবং ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কায় পড়ছেন। অনলাইন পরীক্ষার কথা ভাবা হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা অত্যন্ত কঠিন। তাই বলে আর কতদিন বন্ধ থাকবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান! সম্প্রতি ইউনিসেফের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশসহ কেবল ১৩টি দেশে। এই ১৩টি দেশের মধ্যে রয়েছে পানামা, বলিভিয়া, এল সালভাদরের মতো দেশগুলো। অঞ্চলভেদে এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আছে কেবল বাংলাদেশ, সর্বোচ্চ নয়টি দেশ আছে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে, মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো থেকে তিনটি এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি দেশ। আর এসব দেশে এ দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী।
করোনার কারণে শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং সেশনজট কমাতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন পরীক্ষার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইতোমধ্যে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ১ জুলাই থেকে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ডিজিটাল অবকাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। আকাঙ্ক্ষার ফোর-জি নেটওয়ার্ক মূলত বাস্তবতার টু-জি নেটওয়ার্কের একটু বেশি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই নাজুক। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটা প্রধান অংশ আসে গ্রামাঞ্চল থেকে, যাদের বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের দুর্বল আর্থসামাজিক অবস্থাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে বাস্তবতাও বলছে ভিন্ন কথা, অনলাইন ক্লাস কিংবা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কিছু বিভাগের জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছেন না ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, গণমাধ্যমে উঠে আসা বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো কারণে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে যুক্ত হতে পারছেন না। তাহলে অনলাইনে পরীক্ষার মতো বড় একটি সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বৈষম্যের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট, ফলে সরকার কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেউ বলতে পারছে না কবে স্বাভাবিক হচ্ছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে উত্তম। তবে এ নিয়েও কারো পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ করা যাচ্ছে না। যদি করোনার শুরু থেকে কিংবা দেশে ভ্যাকসিন আসার পরপরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবা হতো, আজ হয়তো এমন অনিশ্চয়তা তৈরি হতো না। এভাবে যদি শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে আরো একবছর নষ্ট হয়ে যায়, সে দায় কে নেবে? শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান শিক্ষার সময়টা যাতে আর নষ্ট না হয়, তার দিকে তাকানোর সময় এসেছে। শেষ হয়েও হয়নি শেষ। এখনো যদি একটি সঠিক পরিকল্পনা প্রনয়ণ প্রণয়ন করা যায়, তবুও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া উচিত। পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে সীমিত পরিসরে রোস্টার পদ্ধতি অবলম্বন করে, শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা, খোলা জানালার শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখে মাস্ক পরাসহ ইত্যাদি নির্দেশনা প্রণয়নের মাধ্যমে ক্যাম্পাস খোলা পরবর্তীসময়েও শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। আর শিক্ষার্থীদের নিয়মিত করোনা পরীক্ষার আওতাভুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা এবং যাদের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং ক্যাম্পাসের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মহামারী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যে পরিকল্পনা, সেটি কখনো সুফল বয়ে আনবে না। কেননা কখন এই মহামারী নির্মূল হবে সেটা একেবারেই অনিশ্চিত। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সচেষ্ট হলে শিক্ষার্থীরা ফিরে পাবে তাদের স্বাভাবিক জীবন, দেশের শিক্ষা খাতে ফিরবে প্রাণ। কোনোভাবেই আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সমীচীন হবে না, এটি কোনো সমাধানও নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়