মুক্তমত

শিক্ষাপদ্ধতি ও পরিবেশ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা

  • প্রকাশিত ৭ অক্টোবর, ২০২১

মাজহারুল ইসলাম শামীম

 

ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ’। নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘তুমি আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো’। এসব উক্তিগুলো এখন সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শিশুদের সামর্থ্য ও শক্তিগুলোর স্বাভাবিক ও সুষম বিকাশই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিশুদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো একটি শ্রেণিকক্ষে ১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকলে সেই পড়ালেখা কোনো কাজের পড়া হবে না। আবার, নিয়মানুযায়ী ১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটা ক্লাসরুম হলেও এটা যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি পড়াশোনা অনুপযোগী। ঠিক তেমনি, নিয়মানুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হলে ৩৩ শতক জায়গার প্রয়োজন। কিন্তু আজকে অনেক প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলে খেলাধুলার কোনো মাঠ নেই বললেই চলে। প্রয়োজন আছে স্বাস্থ্যস্মত টিউবওয়েলের। প্রয়োজন আছে ইবাদতখানা। প্রয়োজন আছে একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এর কোনোটিই আসলে দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে নেই।

বর্তমানে অভিভাবকদের ধারণা এই খেলার মাঠবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নাকি মেধা বিকাশের অন্যতম ক্ষেত্র। বিষয়টা অনেকটা ফার্মের মুরগি আর দেশি মুরগির অবস্থার মতো। দেশি মুরগি সারা মাঠ চরে বেড়ায় তার গায়ে মাংস থাকে কম এরা কম খাবার খায় তাই বড় হতে সময় লাগে, অপরদিকে কম জায়গায় অধিক খাবার দিয়ে স্বল্প সময়ে মুরগি বড় হয় ফার্মে যাকে আমরা ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগি বলি। এ দেশে যখন ব্রয়লার মুরগির প্রচলন শুরু হয় তখন সবাই ঝুঁকে পড়েছিল ব্রয়লার মুরগির দিকে, সময়ের পরিবর্তনে এখন মানুষ আবার ফিরে আসছেন দেশি মুরগিতে, এখন ফার্মের মুরগিতে সবারই অরুচি। ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়ার নানা কুফল আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে জানতে পারছি। ঠিক আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটাও ব্রয়লার মুরগির চাষের মতো মেধার বিকাশের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। অভিভাবকরা দ্রুততম সময়ে নিজ সন্তানকে মেধাবী করে গড়ে তোলার জন্য ছুটছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে। বিদ্যালয়ের মাঠ হচ্ছে শিক্ষার সবচেয়ে বড় উপকরণ। পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডির বাইরে শিক্ষণ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে খেলার মাঠ। আবার অনেক অভিভাবক মনে করে অধিকহারে সারাক্ষণ পড়াশোনা, আর কোচিং, প্রাইভেট এসব নিয়ে থাকলে সন্তানটা তাড়াতাড়ি মেধাবী হয়ে উঠবে। বাস্তবে এগুলো হলো ভিত্তিহীন শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষাব্যবস্থা হলো গতানুগতিক মুখস্থ শিক্ষাব্যবস্থা। এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের অধিক হারে বইয়ের বোঝা মাথায় তুলে দেওয়া হয়। যেটা আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনছে না। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে তাদের বয়স অনুসারে বই প্রয়োজন। অতিরিক্ত বইয়ের চাপে তারা দিশাহারা হয়ে পড়াশোনা থেকে অবসর নিতে চাচ্ছে। তারা কোনো আনন্দ পাচ্ছে না পড়াশোনায়। আর দিন শেষে অধিকহারে মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার জন্য বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে। বাড়ি গিয়ে সারা রাত-দিন শুধু মুখস্থ করতে থাকে এসব পড়াশোনা। আমরা সবাই একটা জিনিস বুঝি যত পারি মুখস্থ করে একটা সার্টিফিকেট অর্জন করে একটা ভালো বেতনের চাকরি পেলে সব সার্থক হবে। কিন্তু এই মুখস্থ গতানুগতিক বিদ্যা একসময় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিবে। দেশে এক সময় মেধা শূন্যতা দেখা দিবে। শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য যখন চাকরি পাওয়া হয়ে যায়, তখন মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনা পদ্ধতি অধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে মুখস্থ পড়াশোনার কোনো ভিত্তি নেই। প্রয়োজন কর্মমুখী এবং ব্যবহারিক পড়াশোনার। যার মাধ্যমে দক্ষ হয়ে উঠবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। আজকে বাংলাদেশে নামকরা অনেক কোম্পানি রয়েছে। যারা কিনা তাদের মেধা দিয়ে বাংলাদেশের হাজারো শ্রমিকের হাত-পা ব্যবহার করে বাংলাদেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা তাদের অধীনে কাজ করছি মাত্র। তাই আমাদেরকে মস্তিষ্কের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে।

পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উন্নয়ন, শিক্ষকের যোগ্যতা, ছাত্র-শিক্ষক সমানুপাত, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর, শারীরিক শাস্তি বন্ধ— এই বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার আগ্রহ বাড়বে। তারা নিজের আনন্দের সাথে বিদ্যালয়ের দিকে ছুটে যাবে। তারা বিশ্বের চলমান জ্ঞানের সাথে তাল মিলাতে পারবে। একই সঙ্গে শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ অন্যান্য শিক্ষা সহায়ক কার্যাবলী আজকে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের প্রতি উৎসাহ বাড়াবে। সুতরাং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যন্ত এলাকায় আরও স্কুল স্থাপন, স্কুলের কাঠামো উন্নয়ন, আরও ভালো যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, দৈহিক শাস্তিদান বন্ধ, বৃত্তি প্রদান, বিনামূল্যে শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

জরিপে দেখা গেছে, মানসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন বলেছে শহরের ৮৯ শতাংশ ও গ্রামের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়ার সুযোগের কথা বলেছে শহরের ৮৬ শতাংশ ও গ্রামের ৮১ শতাংশ শিশু। বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণের কথা বলেছে শহরের ৭৯ শতাংশ ও গ্রামের ৭৪ শতাংশ শিশু। মানসম্মত শিক্ষার কথা বলেছে ৭৩ শতাংশ শিশু। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তি ৭২ শতাংশ, বিদ্যালয় ভবন ৬৭ শতাংশ, খেলার মাঠ ৬৬ শতাংশ ও প্রাইভেট কোচিং বন্ধের কথা বলেছে ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। বর্তমানে কোচিং এবং প্রাইভেটের জন্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটা আজ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অথচ শিক্ষা ছিলো সেবাধর্মী ব্যবস্থা। কিন্তু এই টাকা পাওয়ার লোভে সবাই আজ সেবা থেকে মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত।

শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের সঠিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে এবং শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজকাল অধিকাংশ অভিভাবকই তাদের সন্তানদের জন্য সুস্থ পরিবেশে একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ করেন। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত বয়সী শিশুদের জন্য সঠিক শিক্ষাপাঠ্যক্রম বেছে নেওয়া বেশ জরুরি। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। তাদেরকে দক্ষ করে তুলতে বাস্তবমুর্খী শিক্ষার বিকল্প নাই।

আমরা শুধু মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা দিকে না গিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দের বিষয়েও নজর রাখতে হবে।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। কবিগুরুর এই অমর বাণী আইবি পরিচালিত শিক্ষার কার্যক্রমের মধ্যে পরস্ফুিটিত হয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়হীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শারীরিক শাস্তির ব্যাপারে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিমত হচ্ছে, শিক্ষকদের শারীরিক শাস্তিদানের বিষয়ে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। অন্যদিকে, শহর ও গ্রামাঞ্চল মিলিয়ে ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীরা বলেছে, শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে আইন বাস্তবায়ন করলে বিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার ঘটনা আর ঘটবে না। আবার শিক্ষার জন্য নিরাপদ শিক্ষা ক্যাম্পাস প্রয়োজন। যেখানে শিক্ষার্থী কোনো হয়রানি বা নির্যাতনের স্বীকার হবে না। নিরাপদে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে পারবে। কোনো দুর্বৃত্ত দ্বারা হামলার স্বীকার হবে না। কোনো ছাত্রী ধর্ষণের স্বীকার হবে না। এসব নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।

জরিপে দেখা যাচ্ছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বা পিছিয়ে থাকা শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য আরও বেশি করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আরও বেশি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষার্থীর চাপ কমবে। তখন শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের যত্ন সহকারে পড়াতে পারবেন। বর্তমানে অনেকাংশে দেখা যায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়ম। এসব অসঙ্গতির জন্য প্রয়োজন মাফিক শিক্ষক পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। যার ফলে বিশ্বমানের জ্ঞানও পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেলো বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.১৩%, যা অত্যন্ত হতাশার কথা। তার অর্থ দাঁড়ায় আগামীতেও দেশে শুধু বিদেশিরাই বড় বড় চাকরির বাজার দখল করবে। আর বিদেশি কোম্পানিরা এসেও দেশে ব্যবসা করবে। তখনও এই মেধাহীন শিক্ষা বছর বছর সার্টিফিকেটধারী বেকারের জন্ম দেবে। এ থেকে উত্তরণে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads