‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’- এ কবিতার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কবিতার সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি হলো সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে তার নিজস্ব জায়গায় উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া মৌজায় স্থাপিত হচ্ছে ৩৫তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’। ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’-এর যাত্রা শুরু হয়েছে।
এই শাহজাদপুর ঘেঁষে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। করতোয়ার একটা শাখা যুক্ত হয়েছিল বড়াল নদীর সঙ্গে। এই শাখা নদী খোনকারের জোলা কুঠিবাড়ির সামনে দিয়েই বহমান ছিল।
কবিগুরু এই নদী দিয়ে তার বোট ‘চিত্রা’ ও ‘পদ্মা’ দিয়ে যাতায়াত করতেন। সেটি এখন ভরাট। এ নদী দেখেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
শাহজাদপুরের কাচারিবাড়িটি ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ৩১ দরজাবিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন। প্রায় দশ বিঘা জমির ওপরে নির্মিত ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার এবং প্রস্থ ১০.২০ মিটার এবং উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার।
ভবনটির প্রতিতলায় সিঁড়িঘর বাদে বিভিন্ন আকারের সাতটি ঘর রয়েছে। ভবনটির উত্তর-দক্ষিণে একই মাপের বারান্দা। বারান্দায় গোলাকৃতি থামের উপরাংশের অলঙ্করণ, বড় মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের উপরের দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভবনটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনভিত্তিক জাদুঘরে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্রে লেখা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই চিঠি জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। ভবনটির পশ্চিমে বকুল গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার বাঁধানো একটি মঞ্চ আছে। এটি ‘রবীন্দ্র মঞ্চ’ বলে পরিচিত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে এসেছেন অনেকবার। এখানে অবস্থানকালে কবিতা, প্রবন্ধ, ছোট গল্পসহ অনেক অমর রচনাবলি লিখেছেন কবি। তিনি নেই, কিন্তু তার পায়ের চিহ্ন রয়ে গেছে কাচারিবাড়িসহ শাহজাদপুরের বিভিন্ন স্থানে। সঙ্গে রয়েছে তার জীবনের নানা স্মৃতি। কাচারিবাড়িতে রক্ষিত অর্ডার বুক থেকে জানা যায়, জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিগুরু ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম শাহজাদপুর আসেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসেছেন।
শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল নীলকরদের কুঠি। যে কারণে এখনো এটা ‘কুঠিবাড়ি’ বলে পরিচিত। পরে কবিগুরুর ঠাকুর দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় কিনে নেন। এই এলাকা নাটোরের জমিদারির অংশ ছিল। জমিদারি কিনে নিলে প্রায় ১০ বিঘা জমিসহ এই কুঠি বাড়িটিও কবি পরিবারের হাতে আসে।
বর্তমানে কবির পরশধন্য এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর দায়িত্ব নিয়েছে। এই ভবন চত্বরে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে রবীন্দ্র অডিটরিয়াম। বর্তমানে কুঠিবাড়িটির উত্তর দিকের প্রধান ফটকের সামনে হাট কর্তৃপক্ষ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের এই কুঠিবাড়ি এখন ইতিহাস হয়ে হাতছানি দেয় সবার কাছে। ছুটে যেতে মন চায় তার পদচারণার ওই ভূমিতে।
শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ির সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫শ’ দর্শনার্থী কাচারিবাড়ি পরিদর্শনে আসেন। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯ জন বিদেশিসহ ১ লাখ ২ হাজার ৮৯০ জন দর্শনার্থী পরিদর্শন করেন। এতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুসেইন খান জানান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরের গৌরব। শাহজাদপুরের ইতিহাস জানতে গেলে প্রথমেই তার নামটি উচ্চারিত হয়। বর্তমান সরকারের আমলে কবিগুরুর নামানুসারে শাহজাদপুরে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’ নামে ৩৫তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে তিন দিনব্যাপী প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, শিল্পকলা একাডেমি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলসহ সব অঙ্গ সংগঠনের সদস্যগরা উপস্থিত থাকেন।