জাতীয়

শামীম-মনিরের নিয়ন্ত্রণে গণপূর্ত!

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২ জুলাই, ২০২১

ক্যাসিনো সম্রাট জি কে শামীম ও গোল্ডেন মনির সিন্ডিকেটের সহযোগী দুর্নীতিবাজ কিছু প্রকৌশলীর হাতে এখনো জিম্মি গণপূর্ত অধিদপ্তর। বিশেষ করে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামিম আখতারকে সামনে রেখে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে মামলা থাকা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন বদলি, টেন্ডার ও নিয়োগবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, এক সময় জি কে শামীমের নিয়ন্ত্রণেই ছিল সবকিছু। তাকে গ্রেপ্তারের পর গোল্ডেন মনির পুরো সিন্ডিকেটটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। বর্তমানে এ দুই প্রভাবশালী কারাগারে থাকলেও তাদের সহায়তাকারী প্রকৌশলীদের সিন্ডিকেটটি তাদের হয়েই কাজ করছে।

অভিযোগ রয়েছে, তারা কারাগারে থাকলেও ছায়া হিসেবে কাজ করছে ৩ প্রকৌশলীর এ সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ও নগর গণপূর্ত বিভাগের সদ্য সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, যিনি সম্প্রতি উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এসব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তবে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে দুদক বলছে, অনুসন্ধান এখনো অব্যাহত রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ জি কে শামীম সিন্ডিকেটের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বর্তমানে সিন্ডিকেট প্রধান। এ কে এম সোহরাওয়ার্দী জি কে শামীম সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে জি কে শামীম সিন্ডিকেটের সমন্বয় করতেন এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে সচিব মো. শহিদ উল্লাহ খন্দকারের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।

মোহাম্মদ শওকত উল্লাহর বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান চলমান থাকার পরও সেটি সম্পূর্ণ গোপন করে টাকার বিনিময়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা তার নাম সরকারের উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সকল বদলিবাণিজ্যে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের পরামর্শে প্রধান প্রকৌশলী করে থাকেন এবং দায়িত্বে আসার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় প্রতিহিংসাবশত আড়াই শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়।

গণপূর্তের ঠিকাদার কাওছার আলম জানান, অতিরিক্ত প্রকৌশলী প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ফিফটি পার্সেন্ট হারে কমিশন নিয়ে থাকেন। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে সংসদ ভবনে কর্মরত থাকা অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি জামাত জোট সরকারের ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বাসভবন সংলগ্ন তার গরু-ছাগল, হাস-মুরগির খামার গর্ণপূর্তের টাকায় নির্মাণ করেন এবং গরুর ঘাস সরবরাহের নামে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে বর্তমান ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বীর নেতৃত্বে গঠিত সংসদীয় তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করে। জি কে শামীমের অন্যতম সহযোগী হিসেবে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি তাকে তলব করে চিঠি দিয়েছিল দুদক (স্মারক নং-০.০১.০০০০.৫০২.০১.১০১.১৯.১৫৭৪, তারিখ-১২/১০/২০২০)। দুদকের মামলায় মাফিয়া ঠিকাদার জি কে শামীমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক কর্মকর্তা, জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম গণপূর্তের যেসব প্রকৌশলীর নাম বলেছে মোসলেহ উদ্দিন তাদের মধ্যে অন্যতম বলে দুদক সূত্রে জানা যায়।

জানা যায়, জি কে শামীম সিন্ডিকেটের মূল উত্থান শুরু হয় অধিদপ্তরের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও মো. সাহাদত হোসেন এর হাত ধরে। মো. রফিকুল ইসলাম অবিভক্ত ঢাকা গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার হাত ধরে জি কে শামীম সিন্ডিকেট ঢাকার গণপূর্ত অধিদপ্তরের সকল কাজ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। রফিকুল ইসলাম গণপূর্তের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে যোগদানের সাথে সাথে তার স্টাফ অফিসার (নিবার্হী প্রকৌশলী) হিসাবে নিয়ে আসেন এ কে এম সোহরাওয়ার্দী, যে ছিল জি কে শামীম সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার।

প্রকৌশলী মোসলেউদ্দিনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :

অষ্টম জাতীয় সংসদে অনিয়ম, দুর্নীতি তদন্তে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়াকে (ডেপুটি স্পিকার) প্রধান করে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু ওই সুপারিশ অনুযায়ী কোনও ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিন প্রকৌশলী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। এই তিন প্রকৌশলীর একজন বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদ। ২০০২-২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তিন দফা পদোন্নতি পাওয়ার পর মোসলেহউদ্দিনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করেন কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম। তিন কোটি টাকা খরচ করে  চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহউদ্দিন। গণপূর্ত অধিদপ্তরে কমিশনভোগী মোসলেহউদ্দিন  ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত। ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি করেছেন তিনি। ঢাকা ও কুমিল্লায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে তার।

মোসলেহউদ্দিনকে গত ১৩ জানুয়ারি তলবি নোটিশ পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয় ‘সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদার জি কে শামীমসহ অন্য ব্যক্তিরা। এর মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্যাসিনো কা্লের সঙ্গে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ঘটনা ঘটেছে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য নেওয়া জরুরি।’

এজন্য গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল মোসলেহউদ্দিনকে। সেই অনুযায়ী হাজির হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় গণপূর্ত অধিদপ্তরে ঠিকাদার-প্রকৌশলী সিন্ডিকেট, অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার ও বাড়ির মালিক হওয়া, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দেন দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন।

এ বিষয়ে জানতে মোসলেহউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শামীম সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত উল্লাহ আর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দীকে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসাবাদও করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বলেন, বিভিন্ন অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে, সেই অভিযোগগুলো অনুসন্ধনাধীন আছে এবং সে অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির করার জন্য দুদক কাজ করছে। 

প্রসঙ্গত ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে বিদেশি মদ, অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ নগদ টাকাসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন জিকে শামীম। এর প্রায়  এক বছর পর ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় নিজ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে।

প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার সরকারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ তার নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গণপূর্ত বিভাগে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র পর্যন্ত শামীমের ঠিকাদারির হাত বিস্তৃত।

আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীম সিন্ডিকেটের পতনের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। প্রকল্পসহ অন্যান্য কাজ বাস্তবায়নে ফিরে এসেছিল স্বাভাবিকতা। জি কে শামীম জেলে যাওয়ার পর তার স্থান দখল করে নেন গোল্ডেন মনির। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির দায়ে সাজা খেটে আসা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসুর সহযোগিতায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে একচ্ছত্র আধিপত্য নেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads