সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। আগামী ২১ মার্চ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এইদিন দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণ।
জানা গেছে, আগামী ২০২৫ সালে ২৫ হাজার ১৯৯ এবং ২০৩০ সালে ৩৩ হাজার ৭০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে ক্যাপাটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে দেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। অবশ্য দেশের চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা খানিকটা বেশি ধরা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে বেশি দামের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর মধ্যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেশি। সাশ্রয়ী দাম নিশ্চিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
এদিকে, আগামী অর্থবছরে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা জোরদার করে গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ৩০ হাজার ৭৩৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই সময় বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম সমন্বয় করে ভর্তুকি কমানো হবে। বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়া হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াটে। এর ১০ ভাগ হবে নবায়নযোগ্য। আর এ সময়ে এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হবে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা।
তবে প্রাথমিক জ্বালানি চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস থাকছে আমদানি। বিদ্যুৎ জ্বালানির পরিকল্পনায় প্রধানত দুটো বিষয়কে জোর দেওয়া হয়েছে। দাম সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তুকি কমানো আর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বাড়ানো। বিদ্যুৎ জ্বালানির বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি একাধিক জ্বালানি ব্যবহার করা হবে মাতারবাড়িসহ একাধিক স্থানে।
জানা গেছে, জ্বালানি ভেদে উৎপাদন খরচে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গত ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। আর সবচেয়ে কম পানি বিদ্যুতে। ডিজেল দিয়ে উৎপাদন খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ২৬ টাকা। এরপর বেশি খরচ হয় ফার্নেস অয়েলে প্রতি ইউনিট ১৭ টাকা এবং এলনজিতে ১৩ টাকা সৌর ১২ টাকা, আমদানি করা কয়লায় ৮ টাকা ১০ পয়সা, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ ৬ টাকা ৪৬ পয়সা, দেশীয় কয়লায় ৬ টাকা, দেশের গ্যাসে ২ টাকা ৫৭ পয়সা এবং পানি বিদ্যুতে উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট ১ টাকা। এজন্য বিদ্যুৎ জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরে পর্যায়ক্রমে গ্যাস বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হবে বলেও সূত্র জানায়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমানে প্রতিদিন গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থেকে বর্তমানে (২০২০-২১) ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় দিন-রাতে এক-দুই বার লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ২০২১-২০৪১ মেযাদে বিদ্যুতের চাহিদা ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বাড়বে। সেই লক্ষ্যপূরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী ৫ বছরে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। চলমান কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গতকাল সোমবার বিদ্যুৎ ভবনে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স অব বাংলাদেশ (এফইআরবি) ও নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) যৌথ আয়োজিত ‘মিট দ্যা প্রেস’- এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা জানান। তিনি বলেন, মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন শতভাগ বিদ্যুতায়ন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে দুর্গম চরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। নদ-নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবল টেনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ লাইনের। আবার পার্বত্য অঞ্চলের যেসব স্থানে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া দুঃসাধ্য, সেখানে সোলার প্যানেল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ, মাতারবাড়ি, রামপাল, পায়রা এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য।
নসরুল হামিদ আরো বলেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ গুণ বেড়েছে। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিদ্যুৎসহ দেশে এখন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। আরো ১৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে। আগামী ২১ মার্চ শতভাগ বিদ্যুতায়নেরও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। বিদ্যুতায়ন এখন ৯৯ দশমিক ৮৫ ভাগ, এটাকে শতভাগই বলা যায়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পার্বত্য এলাকায় গভীর কূপ খনন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে সেখান থেকে ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে আমাদের চাহিদা বাড়ছে হাজার হাজার ঘনফুট। রাশিয়া ইউক্রেন সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর এখনো পড়েনি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তবে যুদ্ধ দীর্ঘ হলে সংকট হতে পারে। এখনো গ্যাজপ্রম বা রূপপুরে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
একাদশ জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের উত্থাপিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিদ্যুৎ বিভাগ এর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা জোরদার করে গ্রাহকের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ৩০ হাজার ৭৩৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তার মন্ত্রণালয়। তবে প্রত্যাশার চেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।
কাতার সফর প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাদের কাছে দীর্ঘ মেয়াদে ১.৫ মিলিয়ন এমএমসিএফডি আমদানির অনুরোধ করেছি। তারা দু-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে আমাদের জানাতে চেয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করছি। আমাদের চুক্তিতে দুই ধরনের অপশন রয়েছে, আমরা সর্বোচ্চ পরিমাণে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে বিবেচনা করার অনুরোধ করেছি।
এদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পেরেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এখনো শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পারেনি। সন্দ্বীপে, রাঙ্গাবালি দ্বীপেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি, ওই অঞ্চলের মানুষও একসময় বিশ্বাস করতে চায়নি বিদ্যুৎ পাবে। হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যমুনা, তিস্তার অনেক দুর্গম চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
এনডাবিউপিজিসিএলের সিইও এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৩৬ মাসের মধ্য নির্মাণসম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে কম সময়ে আধুনিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের রেকর্ড। কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর প্রভাব পড়বে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে খোরশেদুল আলম বলেন, ৬৩০০ কিলো ক্যালরি কয়লার দাম বেড়েছে, আমরা কিনছি ৫০০০ কিলো ক্যালরি, যার দাম ১০৫ থেকে ১০৭ ডলার পড়ছে। সে কারণে এখনো সমস্যা দেখছি না।