মুক্তমত

শতবর্ষেও চির উজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • প্রকাশিত ৪ জুলাই, ২০২১

মো. তাসনিম হাসান আবির

 

বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, গৌরব-সবকিছুর সঙ্গে যে নামটি জড়িত তাহলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই এর প্রতিষ্ঠার দিনটির হিসেবে গত ১ জুলাই পূর্ণ হলো শতবর্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দ্যুতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো নেই যার নাম নিজ দেশের ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আছে। এ গৌরব কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জাতির বিবেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল শত শত আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশার ওপর ভর করে। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষত্ব হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে এর বিশেষ অবদান ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর তাই প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতি বছর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের) ডিগ্রি ক্লাসে অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষক এবং লাইব্রেরির বই ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এই দুটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতাদানের কৃতজ্ঞতা হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের নামকরণ করা হয় ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ও জগন্নাথ হল। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা,  রসায়ন, গণিত ও আইন। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বেলে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি। তৈরি করেছে অসংখ্য গুণী ও বিদ্বান। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে কর্মরতদের অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাদের অন্যতম—হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ. সি. টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ (ইংরেজি বিভাগ; এমএ-১৯২৩)।

দেশের সর্বপ্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট এবং ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্যে রয়েছে ২০টি আবাসিক হল ও ৩টি হোস্টেল। প্রতিষ্ঠার এত বছরে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাঙালির আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এইচএসসি পাসের পর শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের ভর্তিযুদ্ধের কথা সকলের জানা। বাঙালি জাতির সমস্ত মহান কাজের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটির নাম জড়িত আছে। এখানকার শিক্ষার্থীদের মানবতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, পড়ালেখার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক হয়ে দেশের প্রয়োজনে নামার মহান ব্রতে দীক্ষা দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই গড়ে উঠেছে বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন), ডিবেটিং ক্লাবের মতো অসংখ্য সংগঠন, ক্লাব। দেশের যেকোনো দুর্যোগে এখানকার শিক্ষার্থীরা সর্বদাই আগে থাকে। জাতির ক্রান্তিকালে যখন সবাই দিশেহারা হয়ে গেছে, তখন পথ দেখিয়েছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস রক্তের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবক্ষেত্রেই এগিয়ে এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তবে শতবর্ষে এসেও এতসব প্রাপ্তির মাঝেও কিছু সমস্যা এখনো দূর করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে আবাসিক সংকট একটি বড় সমস্যা। এখানকার শিক্ষার্থীরা অনেক কষ্টে নিজেদের থাকার জায়গা পূরণ করছে। তাছাড়া এখানে আছে গ্রন্থাগার সমস্যা। শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য অত্যাধুনিক কোনো গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এখানে আছে পরীক্ষার হলের সংকট। হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গবেষণা চুরিরও অভিযোগ আমাদেরকে ব্যথিত করে। তবে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে শাস্তির উদাহরণও আমরা দেখেছি। শিক্ষার্থী নির্যাতনেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্র রাজনীতিও এখন বিবেকবর্জিত। এসব কিছুই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের জন্য অবমাননাকর।

তাই শতবর্ষে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। তারা চায় সুস্থ রাজনীতির চর্চা যেন ক্যাম্পাসে হয়। আবাসিক সমস্যার সমাধান হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে খাবারের মান বাড়াতে হবে। অত্যাধুনিক গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। টিএসসির ঐতিহ্য বজায় রেখে এর আধুনিকায়ন জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। বহিরাগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে থাকা ভিক্ষুক, পথশিশু বা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের অন্যত্র পুনর্বাসন করতে হবে। পড়ালেখার মান উন্নয়নে এসব সমস্যার সমাধান কাম্য। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগে আরো স্বচ্ছতা আনতে হবে। নতুবা মানসম্মত শিক্ষা থেকে জাতি বঞ্চিত হবে।

একটি সুশিক্ষিত ও সভ্য জাতি গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঢাবিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও অগ্রগতিতে নিবেদিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই শতবর্ষে এসেও চির উজ্জ্বল প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads