শঙ্কা বাড়াচ্ছে ওমিক্রন!

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু দ্বিগুণ, শনাক্ত ১১%

শঙ্কা বাড়াচ্ছে ওমিক্রন!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এমন হুশিয়াতে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। ভারতীয় একজন শীর্ষ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘ওমিক্রন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর হলেও প্রায় অপ্রতিরোধ্য। বুস্টার ডোজ ওমিক্রন থামাতে পারবে না এবং এতে সবাই শেষ পর্যন্ত সংক্রমিত হবেন।’

এ অবস্থায় করোনার যেকোনো নতুন ধরন মোকাবিলায় বাংলাদেশে আগে থেকেই নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে সংক্রমণের রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা ও রাঙামাটি জেলাকে। এছাড়াও মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে রাখা হয়েছে যশোরসহ সীমান্তবর্তী ৬ জেলাকে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোকে সাবধানতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওমিক্রনে অভূতপূর্ব স্পাইক মিউটেশন হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এগুলো মহামারির গতিপথ বদলে দিতে পারে। এতে সংক্রমণ বেড়ে কিছু অঞ্চলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এছাড়া নতুন এ ধরনের বিরুদ্ধে প্রচলিত টিকাগুলো কার্যকর কিনা তা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে হু।

সংস্থাটি বলেছে, ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ, তীব্রতার পরিবর্তন নির্বিশেষে ওমিক্রন করোনাভাইরাস স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য চাপ তৈরি করতে পারে এবং অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিতে পারে। অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব গুরুতর হবে, বিশেষ করে কম টিকা দেওয়া দেশগুলোতে।

ভারতীয় শীর্ষ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর হলেও ‘প্রায় অপ্রতিরোধ্য’। ওই বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে দেশটির একটি শীর্ষ সংবাদমাধ্যম জানায়, এতে সবাই শেষ পর্যন্ত সংক্রমিত হবেন।

মহামারি বিশেষজ্ঞ এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন ড. জয়প্রকাশ মুলিল এ বিষয়ে আরো বলেছেন, টিকার বুস্টার ডোজ ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার বন্ধ করবে না। এটা কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না, সংক্রমণ ঘটবেই।

কোভিড এখন আর কোনো ভয়ঙ্কর রোগ নয় দাবি করে এ মহামারি বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি এমন একটি রোগ, যা আমরা মোকাবিলা করতে পারি। তবে আমরা এখন ভিন্ন একটি (ওমিক্রন) ভাইরাসের মোকাবিলা করছি। এটি ডেলটার চেয়ে কম শক্তিশালী হলেও কার্যত অপ্রতিরোধ্য। যদিও ওমিক্রন এখন ঠান্ডাজনিত অসুস্থতার মতো। ভাইরাসটি মাত্র দুদিনের মধ্যে সংক্রমণ দ্বিগুণ করে। তাই, পরীক্ষায় এর উপস্থিতি শনাক্ত করার আগেই সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে বিপুল মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে। 

গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ড্যাশবোর্ড ওয়েবসাইট থেকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি বিবেচনায় ঢাকা ও রাঙামাটি জেলাকে রেড জোন বা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া মধ্যম পর্যায়ের (হলুদ জোন) ঝুঁকিতে রাখা হয়েছে যশোরসহ সীমান্তবর্তী ছয় জেলাকে। মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলো হলো- রাজশাহী, রংপুর, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, যশোর। এসব জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে অবস্থান করছে। আর রেড জোনে থাকা ঢাকা ও রাঙামাটি জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ১০ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশ। আর সংক্রমণের গ্রিন জোন বা ক্ষীণ ঝুঁকিতে আছে ৫৪ জেলা। অন্যদিকে পঞ্চগড় ও বান্দরবান জেলায় নমুনা পরীক্ষার হার খুবই কম হয়েছে বলে জানায় অধিদপ্তর। ক্ষীণ ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলো হলো- চট্টগ্রাম, বগুড়া, গাজীপুর, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া, নীলফামারী, বরগুনা, শেরপুর, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট, নারায়ণগঞ্জ, নওগাঁ, ঝালকাঠি, খুলনা, পটুয়াখালী, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, বরিশাল, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, সিলেট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, খাগড়াছড়ি, ঝিনাইদাহ, পাবনা, মাদারীপুর, মাগুরা, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, ভোলা, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নড়াইল। বাংলাদেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন বা লাল, হলুদ ও সবুজ- এই তিন ভাগে ভাগ করে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ঢাকা এবং রাঙামাটি বর্তমানে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলা থেকে সহজেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে এ দুই জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজশাহী, রংপুর, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, যশোরসহ ছয় জেলা মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে। আর বাকি ৫৪ জেলা সংক্রমণের গ্রিন জোন বা ক্ষীণ ঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

রোবেদ আমিন বলেন, কোনো জেলায় ১০ শতাংশের ওপরে সংক্রমণ চলে গেলেই এটিকে আমরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করি। এসব জেলা থেকে কিন্তু খুব সহজেই বাকি জেলাগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই কম ঝুঁকিতে থাকা এলাকার বাসিন্দাদেরও সতর্ক হতে হবে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সব জেলাগুলোকেই সাবধানতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বলেছি।

দেশে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের শরীরে ওমিক্রন সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সোমবার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (জিআইএসএআইডি) আক্রান্তদের শরীর থেকে নেওয়া ভাইরাসের নমুনার জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করে ওমিক্রন সংক্রমণের তথ্য পাওয়ার কথা প্রকাশ করেছে। শনাক্ত রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাসিন্দা। ওমিক্রনে বাংলাদেশের কারও সংক্রমিত হওয়ার খবর প্রথম এসেছিল গত বছর ৯ ডিসেম্বর। এক মাসের মাথায় শনাক্তের সংখ্যা ত্রিশে পৌঁছালো।

করোনা ভাইরাসের শনাক্ত করন বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর জানান, বিদেশফেরত কারও কোভিড ধরা পড়লে তাদের শরীর থেকে ভাইরাসের নমুনা নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে নমুনা নিয়েও জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে দেশেও কয়েকজন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে আইইডিসিআর। 

অন্যদিকে বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে ওমিক্রনের বিস্তারের প্রধান শঙ্কা থাকলেও এটির প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সতর্কতা নেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর, গেল ছয় মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আগের তুলনায় তিন গুণ হয়েছে যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা। কিন্তু, করোনার সংক্রমণ আবারো বাড়তে শুরু করলেও, কোনো সতর্কতা চোখে পড়েনি বিমানবন্দরে। যাত্রী বা দর্শনার্থীদের বেশিরভাগের মুখেই নেই কোনো মাস্ক। কেউই মানছেন না কোনো সামাজিক দূরত্ব। কর্তৃপক্ষ বলছে, এতো অল্প জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। এখনো জারি হয়নি আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, নানা কারণে বর্তমানে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। এতো মানুষের ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কঠিন, মানানো আরো কঠিন।

তিনি জানান,  গেল বছর চার ডিসেম্বর থেকে আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা, ঘানা, লেসোথো, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ে থেকে যারাই আসবে তাদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে।

কিন্তু আফ্রিকা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাতেও সমানে ছড়াচ্ছে করোনার ওমিক্রন ধরন। গেল এক মাসে ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে বেড়েছে এর প্রভাব। যদিও এ ব্যাপারে কোনো সতর্কতা এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দরের পরিচালক।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত একদিনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে ২৮ হাজার ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৯১৬ জন। শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশে। শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ এক হাজার ৩০৫ জনে।

গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার করোনায় দু’জনের মৃত্যু হয়। এই সময়ে নতুন করে শনাক্ত হন দুই হাজার ৪৫৮ জন। শনাক্তের হার ছিল আট দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ২৬৬ জন, এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৫৩ জন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ হাজার ৭০৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ২৪ হাজার ৯৬৪টি নমুনা। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads