লোকসানে কৃষক

ছবি : সংগৃহীত

কৃষি অর্থনীতি

চাল কিনতে সরকারের অনীহা

লোকসানে কৃষক

লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশও সংগ্রহ হয়নি আমন ধান

  • নাজমুল হুসাইন
  • প্রকাশিত ২ জানুয়ারি, ২০২০

দেশে এ বছর আমনের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। তবে এতে লাভবান হয়নি কৃষক। বরং লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ বাজারে ধান-চালের দাম নেই। এক মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের যে খরচ হয়েছে, উৎপাদিত ধান বিক্রি করে সে খরচ উঠাতে পারেননি বেশির ভাগ কৃষক।

এজন্য সরকারকে দুষছেন কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কৃষকের কাছ থেকে আমনের ধান-চাল সংগ্রহে চূড়ান্ত অনীহা দেখাচ্ছে সরকার। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেক এলাকায় ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়নি। তাতে বাজারে ধানের দাম পড়ে গেছে। কৃষকের এ লোকসানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের এ গড়িমসিই দায়ী। তথ্যও বলছে সেই কথাই। খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, গত ২০ নভম্বের থেকে সারা দেশে ৬ লাখ টন আমন ধান এবং পহেলা ডিসেম্বর থেকে ৪ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছে। অর্থাৎ এর মধ্যে ধান সংগ্রহের দেড় মাস ও চাল সংগ্রহের একমাস সময় পেরিয়ে গেছে। তারপরও চলতি আমন মৌসুমে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৮ হাজার ৩২১ টন ধান ও ৬০ টন আমন চাল সংগ্রহ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশেরও কম।

জানা গেছে, এ সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সে হিসাবে এখন সংগ্রহের পরিমাণ অর্ধেকের কাছাকাছি হওয়ার কথা। তবে বিভিন্ন এলাকায় প্রাপ্ত খবর বলছে, নির্ধারিত সময়ের প্রায় অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও বিভিন্ন  উপজেলায় এখনো সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। কিছু এলাকায় শুরু হলেও গতকাল পর্যন্ত কৃষকদের তালিকাই চূড়ান্ত করতে পারেনি বেশির ভাগ উপজেলার খাদ্য অধিদপ্তর। এতে হতাশ সেখানকার কৃষকরা।

এরপরও নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর। জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ) জুলফিকার রহমান বলেন, কয়েকটি কারণে সংগ্রহ কার্যক্রমে দেরি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ অবহাওয়া। আমরা ধান কিনতে চাচ্ছি, তবে কৃষক ধানের আর্দ্রতা (১৪ মাত্রায়) ঠিক রেখে ধান নিয়ে আসতে পারছে না। এ কারণে অনেকখানে ধান কেনা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, নানা কারণে অনেক এলাকায় কৃষকদের তালিকাই চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও কিছু পারিপার্শ্বিক সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। আবার অনেক তালিকায় থাকা এলাকায় কৃষকদের ধান সংগ্রহ করতে গেলে তারা জানেই ধান বিক্রি করতে হবে। আবার পুরনো তালিকা হওয়ায় অনেকে ধান দিতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে কৃষকরা বলছে, এবার আমনের মৌসুমে প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। অথচ উৎপাদন খরচ ছিল ৮৫০ টাকার বেশি। সংগ্রহ কার্যক্রমের জটিলতায় উৎপাদন খরচের চেয়ে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কমে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

নওগাঁর কোলা গ্রামের কৃষক হেলাল মিয়া বলেন, আমার এলাকার অনেক কৃষক সরকারি খাদ্যগুদামে ধান দিতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশ করাসহ বিভিন্ন ঝামেলার কারণে প্রয়োজনের সময় গুদামে ধান দিতে না পেরে তারা পাইকারদের কাছে সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এখন গুদামে আসল কৃষকের বদলে ধান দিচ্ছেন ভেজাল কৃষক।

যদিও সরকার কৃষক যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পায় সে জন্য মৌসুমের শুরুতে নির্ধারিত দামে ধান সংগ্রহ করার কথা। এজন্য প্রতি কেজি ধানের দাম ২৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে হিসাবে প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার ধান না কেনায় বাজার চড়েনি। সে কারণে মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে কৃষকরা নানাভাবে লোকসানের কবলে পড়েছেন। আবার জটিলতার কারণে কৃষকের বদলে সরকারকে ধান দিচ্ছেন ফড়িয়া ও চাতাল-মিল মালিকরা ।

এসব বিষয়ে প্রতিবেদকের কথা হয় আরো কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তারা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে ক্রয়যোগ্য ধানের আর্দ্রতার ন্যূনতম মাত্রা (১৪ শতাংশ) বেঁধে দেওয়া। কিন্তু খতিয়ে দেখা হয়নি এই শীতের মৌসুমে ধানচাষিদের ধান অতটা ভালোভাবে শুকানোর ব্যবস্থা আছে কি না। ধানচাষিরা ধান শুকান মাটির উঠানে। ফলে আমন মৌসুমে উঠানে ধান শুকিয়ে তার আর্দ্রতা কমিয়ে ১৪ শতাংশে নামানো যায় না। এ আর্দ্রতা নামাতে পারেন চাতালের মালিকেরা, কারণ ধান শুকানোর জন্য তাদের পাকা জায়গা আছে। ফলে সরকারের ধান কেনার কর্মসূচি কার্যত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার কর্মসূচি নয়, এটা চাতালের মালিকদের কাছ থেকে ধান কেনার কর্মসূচি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, সরকারকে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত। তবে তারা ধানের দাম বাড়ানোর জন্য তৎপর নয়। এক ধরনের অনীহা সব সময় কাজ করে।

তিনি বলেন, আমরা অনেক সুপারিশ করে থাকি, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। ধান-চাল কেনার প্রক্রিয়াও জটিল। সরকারের ধান কেনা কর্মসূচির এই মৌলিক অসংগতির কারণে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারছে না। ধানের ন্যূনতম আর্দ্রতার শর্তের সুযোগে খাদ্যনিয়ন্ত্রকদের কার্যালয়গুলোতে ধান কেনার সময় অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads