দেশেই তৈরি হবে হেলিকপ্টার, বিমানসহ সব ধরনের আকাশযান। এসব আকাশযান তৈরি ও মেরামতের কারখানা স্থাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাটকে। প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় আশায় বুক বেঁধেছে লালমনিরহাটবাসী। কারণ তারা মনে করছেন, এখানে কারখানা হলে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানের এবং এভাবেই একদিন লালমনিরহাট থেকে শুরু হবে বিমান চলাচল।
গত ২৪ জুলাই ঢাকায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় এই পরিকল্পনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে তিনি বিমানবাহিনী প্রধানকে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেছেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জেলার পরিত্যক্ত এয়ার স্ট্রিপে প্রথমে অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার স্থাপন করে প্রাথমিকভাবে বিমান ও হেলিকপ্টার মেরামত ও ওভারহোলিংয়ের কাজ করা হবে, পরে সেখানে এসব আকাশযান তৈরিও করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লালমনিরহাটে একটা এয়ার স্ট্রিপ আছে। বিশাল জায়গা পড়ে আছে। আমি আমাদের বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা একটি অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার ঢাকায় করেছি। আর সেখানে এ ধরনের একটি অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার গড়ে তুলব। ভবিষ্যতে সেখানে আমরা নিজেরাই হেলিকপ্টার তৈরি করতে পারব, প্লেনও তৈরি করতে পারব।’
এ সময় তিনি বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা কেন পারব না? আমরা এখন নিজেরা যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছি খুলনা শিপইয়ার্ডে, যেটা একসময় একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিমানবাহিনী প্রধানকে বলেছি একটা প্ল্যান করতে। সেখানে কেবল বাংলাদেশের নয়, আশপাশের দেশের বিমানবাহিনীর বিমান বা হেলিকপ্টারও আমরা ওভারহোলিং করব, মেরামত করব।’
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারকে তথা তৎকালীন ভারতবর্ষকে রক্ষার একটি প্রধান বিমানক্ষেত্র। ১৯৪৫ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা দেশে ফিরতে শুরু করে। সাথে সাথে নিস্তব্ধতায় ডুবে যেতে থাকে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিমান ঘাঁটি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পরিত্যক্ত হয়ে অবহেলা আর অযত্নে ১ হাজার ১৬৬ দশমিক ৬৮ একরের বিশাল পরিধির এশিয়ার এই দ্বিতীয় বৃহৎ বিমানবন্দর তার গুরুত্ব ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে বিমানবাহিনীর কৃষি ফার্মে পরিণত হয়।
এদিকে ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে পুনরায় বিমান সার্ভিস চালু করা হয়। সে সময় লালমনিরহাট-ঢাকা ভাড়া ছিল ৪৫ টাকা। একসময় বিমান সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে ভারতীয় বোমা হামলার পর পাকিস্তান সরকার বিমান ঘাঁটির স্থাপনা নিলামে বিক্রি করে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেড কোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাঙ্গার, ট্যাক্সিওয়ে সবই এখন পরিত্যক্ত।
পরে ১৯৮৩ সালে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ এখানে কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করে, যার কার্যক্রম এখনো চলছে। সরকারি এই মূল্যবান স্থাপনাজুড়ে এখন লালমনিরহাট মিলিটারি ফার্মের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার এবং সংরক্ষিত জমিতে চলছে কৃষিকাজ।
২০১১ সালের ১৯ মে ভুটানের যোগাযোগমন্ত্রী এইচ ই লিয়নব পো নন্দলাল রাজ রায়ের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে লালমনিরহাট সদর-৩ আসনের এমপি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদেরসহ বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তার সঙ্গে ছিলেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভুটান সরকার লালমনিরহাট জেলার লালমনিরহাট সদরের হাড়িভাঙ্গায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বিমান ঘাঁটিটিকে ভুটান-বাংলাদেশ ট্রানজিটের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে ভুটান ও বাংলাদেশের মন্ত্রীপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল বিমানবন্দর স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটিটি পরিদর্শন করে।
সে সময় ভুটান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে একটি যৌথ চুক্তি হয়। এ চুক্তির আলোকে ভুটান সরকার লালমনিরহাট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে সে দেশের বিমান ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। লালমনিরহাট বিমানবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভুটান সরকার লালমনিরহাট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরটি ব্যবহারের জন্য পছন্দের তালিকায় রাখলেও সৈয়দপুর বিমানবন্দরটি চালু হয় কিন্তু আকাশসীমা নিয়ে জটিলতা থাকায় লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সূত্রটি আরো জানায়, ভারত, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি হলেই বন্দরটি ব্যবহার করা যাবে।
মঙ্গার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে অবহেলিত উত্তরাঞ্চলে এখন লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। উন্নয়নের ফলে দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় লালমনিরহাটের জনগণেরও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ অবস্থায় লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি যাত্রী পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে যেমন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পেত বিপুল রাজস্ব, তেমনি এলাকার জনগণও লাভবান হতো দ্রুততম সময়ে ঢাকা যাতায়াতের সুবিধা ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক এই বিমানবন্দরটি একদিকে যেমন তার হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফেরত পেত, গর্ব অনুভব করত লালমনিরহাটবাসী। অন্যদিকে যাতায়াত সুবিধায় বেঁচে যেত এলাকার জনগণের অনেক মূল্যবান কর্ম-ঘণ্টাও।
লালমনিরহাট-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ দুলাল বলেন, লালমনিরহাট বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার ও বিমানসহ সব ধরনের আকাশযান তৈরির কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। এ ঘোষণা লালমনিরহাটবাসীর জন্য খুশির খবর।
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান আকাশযান তৈরির কারখানা স্থাপনের জন্য লালমনিরহাটের নাম ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এখানে হেলিকপ্টার ও বিমান তৈরির কারখানা হলে উত্তরাঞ্চলে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।