নীলফামারী প্রতিনিধি:
গরীব মানুষের তো সোনা,দানা নাই, কিন্ত প্রত্যেক বাড়িতে দুই,একটা গরু আছে। সেই গরু লাম্পি স্কিন রোগে দেদারসে মরে যাচ্ছে। আমার শখের শাহিওয়াল জাতের দুইটি আঁড়িয়া বাছুর প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ করেও বাঁচাতে পারি নাই। চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মরে গেল। চিকিৎসা খরচসহ ৮৫-৯০ হাজার টাকার ক্ষতি হলো ভাই। বাবা, মা মরা শোকের চেয়েও বড় কষ্ট পেয়েছি। এ দুঃখের কথা কার কাছে বলবো। কেবা এই ক্ষতি পুঁশিয়ে দেবে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে কষ্টের কথা গুলো বলেন, নীলফামারী সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের কৃষক শাহাজান আলী। তিনি তার ফেইজ বুক ওয়ালে গরুর ছবি দিয়ে পোষ্ট দিয়েছিলেন। সেখানে হাজার হাজার কৃষক জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগের বিরুদ্ধে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করেন।
সদর উপজেলা পশু হাসপাতালের ভ্যাটেনারী সার্জন ডা. নাসরিন আকতার জানান, এটি করোনা ভাইরাজের চেয়েও মারাত্বক। এর কোন চিকিৎসা আবিস্কার হয়নি। ফলে এই রোগটি বেড়েই চলছে। এতে করে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হচ্ছে দেশি বিদেশী বাছুর। বাছুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় মৃত্যু হার বেড়ে গেছে। গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগের প্রার্দূভাব। আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার গরু। বিপাকে পড়েছে কৃষক।
ওই গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এক পাড়ায় ছোট বড় মিলে ১২-১৪ টি গরু মরে গেছে। গরীব মানুষ গরু পুশিপালি বিক্রি করে দুই টাকা আয় করে। দুই তিন বছর একটা গরুর পিছনে কি পরিমান খরচ ও পরিশ্রম হয়, না পুসলে বুঝা যায়না। আর যার গরু মইছে সেই বুঝে গরু মরার ব্যাথা। তিনি বলেন, টিকা দিয়া করোনা ভাইরাজ বন্ধ করলো সরকার। কিন্ত গরু বাঁচানোর টিকা আনির পায় না। এটা কেমন কথা। এই অসুখ মানুষের হলে হৈ, চৈ শুরু হতো।’
সরেজমিন দেখা যায়, পশু হাসপাতাল গুলোয় নেই টিকা বা প্রয়োজনীয় ঔষুধ। প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আক্রান্ত পশুর মিলছে না চিকিৎসা। মালিকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঔষুধের শ্লিপ। বাজার থেকে কেনা ঔষুধ দিয়ে আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা করেও সুফল পাচ্ছেন না কৃষক। নেই কোন প্রতিষেধক ও টিকার ব্যববস্থা। অনেকে হোমিওপ্যাথিক, কবিরাজি ও পল্লী চিকিৎসকের দারস্থ হয়েছেন।
ভ্যাটেনারী ঔষুধের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ জানান, এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের ঔষুধ কোম্পানি লাম্পি স্কিন ভাইরাজের কোন ঔষুধ বা টিকা তৈরী করতে পারেনি। তাই কোন দোকানে এই রোগের ঔষুধ বা টিকা সাপ্লাই নেই।
গ্রামের পশু চিকিৎসক হৃদয় কুমার রায় জানান, এলাকায় অসংখ্য গরু মরে যাচ্ছে। বিশেষ করে ছোট ছোট বাছুর। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় চিকিৎসা দিয়ে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে হৃদয় বলেন, আমি চিকিৎসা দেওয়ার আগে ভাল করে বলে নেই, এই রোগের কোন সঠিক চিকিৎসা নাই, ভাল হতেও পারে নাও হতে পারে। তার পরেও মানুষ বাদ্য করে চিকিৎসা দিতে। এতে কোনটি ভাল হয়, আবার কোনটি মারা যায়। তবে রোগ থেকে বাঁচার উপায় হলো প্রতিষেধক টিকা। আর গবাদী পশুকে মশা, মাছির হাত থেকে রক্ষা করা ও গোয়াল ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
উপজেলার কচুকাটা ইউনিয়নের বড়বাড়ী গ্রামের কৃষক সৈয়দ আলী, ইটাখোলা ইউনিয়নের সিংদই হাতিবান্ধা গ্রামের আশরাফ আলী জানান, ‘সঠিক চিকিৎসার অভাবে এ রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালে মিলছে না প্রতিষেধক টিকা। অনেকেই ভয়ে সুস্থ্য গরুও বাদ্য হয়ে বিক্রি করছে পানির দামে।’
গরীবের সম্পদ গরু দাবি করে, ক্ষতিগ্রস্ত শাহজাহান ইসলাম বলেন, ‘কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার দেশের উন্নয়নসহ করোনার টিকা সরবারহ করেছিল। কিন্তু লাম্পি ভাইরাজের টিকার অভাবে হাজার হাজার গরু গ্রামে গঞ্জে মারা যাছে। এ ব্যাপারে, প্রাণী সম্পদ বিভাগের নেই কোন মাথা ব্যাথা। সরকারের কাছে টিকা ও ঔষুধ সরবরাহের জোড় দাবি জানাই।’
শাহজাহান এর বাবা কৃষক মোকছেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলের দুইটি বাছুর চোখের সামনে মারা গেল। প্রায় ৮৫-৯০ হাজার টাকা দাম। আমাদেরতো সোনা দানা নাই গরুই আমাদের সম্পদ। কিন্ত সেই সম্পদ রক্ষায় প্রাণী সম্পদ দপ্তরের নাই কোন উদ্যোগ। আগে আমরা দেখছি, জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ় মাসে খুড়া রোগের টিকা গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে দেয়া হতো। এখন বছরেও পশু হাসপাতালের লোকজনের দেখা মিলে না। কি কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরাই ভাল বলতে পারবে।’
বাহালী পাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বিজয় রায়, স্বপন কুমার রায়, দরিবুল্যা মামুদ, ফজলুল হক, দিনোবন্ধু, কাজল, সুরেশ, দুলাল, রশিদুল ও শরিফুল ইসলাম একই কথা বলেন। (এদের প্রত্যেকের গরু মারা গেছে)।
পশু হাসপাতালের ভ্যাটেনারি সার্জন বলেন, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এর কোনো প্রতিকার নেই। তিনি জানান,‘লাম্পি স্কিন রোগে গরুর জ্বর এবং গায়ে ব্যাথা হয়। কিটোপ্রোপেন বা প্যারাসিটামল জাতীয় (ভ্যাট) ব্যথানাশক ওষুধ দেয়া যেতে পারে। এর তীব্রতা বেশী হলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও, গুটিগুলো ফেটে গেলে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা আয়োডিন সলিউশন দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি মশা,মাছি থেকে রক্ষার জন্য গরুকে মশারীর ভিতরে রাখতে হবে এবং ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। ভূল করেও ওজা, কবিরাজ ও পানি পড়া খাওয়াবেন না।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিরাজুল হক কৃষকের অভিযোগ শিকার করে বলেন, এই রোগে জেলায় প্রচুর গরু আক্রান্ত হয়েছে এবং মারাও গেছে। তবে গ্রামের পশু চিকিৎসকরা না জেনে, না বুঝে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে আক্রান্ত গরুগুলোর বেশী ক্ষতি করেছে। যার ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এই রোগের চিকিৎসা নেই, এবং টিকাও আবিষ্কার হয়নি। তবে টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে ঘা ফেটে গেলে কিটোপ্রোপেন বা প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ দিতে হবে। রোগের তীব্রতা বেশী হলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও, ঘায়ে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা আয়োডিন সলিউশন দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্তের বিষয়টি উর্দ্ধোতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, এটি মশা ও মাছির মাধ্যমে বেশি ছড়ায় বলে আক্রান্ত পশুকে গোয়াল ঘরের ভিতরে মশারির নিচে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সুস্থ গরুগুলোকে আলাদা রাখতে হবে। এবং আক্রান্ত গরুকে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।





