লবণ আমদানি এবং উৎপাদকের স্বার্থ

ফাইল ছবি

মুক্তমত

লবণ আমদানি এবং উৎপাদকের স্বার্থ

  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মূলত ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে কোনো পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করে থাকে। যখন দেশীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি হয়, তখন সরবরাহ কমে আসায় সে পণ্যের মূল্য বাড়ে। তখন সরকার ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানি করে। আর অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, আবার সরবরাহ বাড়লে দাম কমে।

অতিসম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন, যা দেশীয়ভাবে উৎপাদিত লবণ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। অথচ সুযোগসন্ধানী কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ১১ লাখ টন লবণ আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় লবণ যদি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, তাহলে দেশের লবণচাষিরা বিপাকে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক।

উল্লেখ্য, লবণচাষিরা অপরিশোধিত লবণ চাষ করে। পরে অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের পর ভোক্তা পর্যায়ে বিপণন করা হয়। চাহিদার বাড়তি লবণ আমদানি করা হলে লবণের বাজার দর যেমন একদিকে আরো কমে আসবে, অন্যদিকে পরিশোধিত বিদেশি লবণের কারণে দেশীয় লবণের মূল্যও কমে আসবে। ফলে লবণচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আগেই বলেছি, পণ্যের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসে। লবণ আমদানির অনুমতি দিলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। যদিও সরকারিভাবে লবণ আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে দেশীয় লবণচাষি এবং লবণ পরিশোধন শিল্পকে বাঁচাতে হলে বেসরকারিভাবে লবণ আমদানির অনুমতি দেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।

এমনিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ সময়েই উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষা হয় না। একটু বাড়তি উৎপাদন হলেই দরপতন ঘটে। ফলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনা শুধু লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয় বরং ধান, সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। গত কয়েক বছর ধরে ধানচাষিরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও এ বছর আমন মৌসুমে সরকার কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে মিলারদের কাছ থেকে চাল কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ধান কেনার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। উল্লেখ্য, এবার আমন মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে কেনার উদ্যোগ নেওয়ার পরও ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বরাদ্দকৃত ধানের সিংহভাগ এখনো কেনা সম্ভব হয়নি। হয়তো শেষ পর্যন্ত কৃষকের পুরো ধান কেনা হলে শেষ পর্যায়ে ধানের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তখন প্রান্তিক চাষিদের কাছে আর ধান থাকবে না। ধান চাল যাবে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে ভোক্তাদের চড়া দামে চাল কিনে খেতে হবে। এই হচ্ছে বাস্তবতা।

বেশ কয়েকদিন ধরে লবণচাষিরা লবণের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতের দাবি নিয়ে মিছিল, মানববন্ধন করছেন। তাদের দাবি, মৌসুমের শুরুতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লবণ আমদানি করা হয়। আর এ সময় লবণ আমদানি হওয়ার কারণে লবণচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। এ বছরও চাহিদার পুরো লবণ দেশীয়ভাবে উৎপাদনের আশা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশীয় লবণ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির পরও যদি সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করেন, তাহলে লবণচাষিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। লবণচাষিদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টির সত্যতা থাকায় সরকারও প্রান্তিক চাষিদের কাছ থেকে এক লাখ টন লবণ কেনার পরিকল্পনা করছে। গত ২০ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ এ টি এম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে লবণ উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজারদর বিষয়ে মতবিনিময় সভায় বেসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সৈয়দ আহামদ এ তথ্য জানান।

মিল মালিক ও লবণচাষিরা বলেন, একটি অসাধু ও অতি মুনাফালোভী লবণ সিন্ডিকেটের কারণে দেশে লবণের বাজার অস্থিতিশীল। সঠিক দাম পান না লবণচাষিরা। লবণ শিল্পবিরোধী চিহ্নিত চক্রকে দমন করতে না পারলে আগামী দিনে লবণ শিল্পখাতকে আরো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তাদের অভিযোগ প্রতিদিনই ফিনিশ লবণ দেশে ঢুকছে, যা কম দামে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। উল্লেখ্য, উৎপাদিত দেশীয় লবণ উদ্বৃত্ত থাকার পরও প্রতিবছরই কম-বেশি লবণ আমদানি করা হচ্ছে। ট্যাক্স ফ্রি সোডিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। নানা কৌশলে যেভাবে লবণ আমদানি করা হচ্ছে তা বন্ধ করে লবণচাষিদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। যার কোনো বিকল্প নেই।

ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, লবণ আমদানি করা হবে না। এক মাননীয় সাংসদ জানিয়েছেন, যদিও লবণ আমদানি বন্ধ রয়েছে, তবু ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে যারা লবণ আমদানি করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ওই সভায় জেলা আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিকও বলেছেন, আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য। লবণচাষিরা দাম না পাওয়ায় আন্দোলন করছেন। যদি লবণচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে সেটা হবে আমাদের ব্যর্থতা।

লবণ মিল মালিক ও চাষিদের ওই সভায় কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রস্তাব করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্থানীয় মিল থেকে সরাসরি লবণ সরবরাহ করা সম্ভব হলে বর্তমান সংকট অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। যদিও এ প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে সবাই চান লবণচাষিদের লবণের মূল্য নিশ্চিত করতে; কিন্তু বাস্তবে যা নিশ্চিত করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে প্রতিবছরই কোন পণ্য কী পরিমাণ চাষ করা দরকার, তা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে কৃষি বিভাগ কিংবা কোনো সরকারি দপ্তরই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ফলে অনুমাননির্ভর কিংবা অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করায় অধিকাংশ সময়ই চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

আর এ কারণেই চাষাবাদের জন্য নেওয়া ব্যাংক ঋণ, এনজিও ঋণ কিংবা মহাজনি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেনাদার হয়ে যান চাষিরা। সেই দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেক সময়ই ব্যাংকগুলো কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত রুজু করে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা বাস্তব এ অবস্থাকে অনেক সময়ই বিবেচনায় নেন না। ফলে দেশে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার পরও সে পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। হয়তো সরকারের মধ্যে পণ্যের সংকট সৃষ্টির একটি ভীতি কাজ করে। কারণ আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও সুযোগসন্ধানী। কোনো কারণে কোনো পণ্যের সামান্য ঘাটতি হলেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ব্যবসায় অনেকেই অতি মুনাফা লাভ করেন। সে কারণে সরকার এক ধরনের শঙ্কা থেকেই নিত্যপণ্যের আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে।

বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেক সময়ই শ্রেণিস্বার্থে উৎপাদকের স্বার্থের চেয়ে আমদানিকারকদের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। ফলে উৎপাদকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। অথচ কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৮ বছরে এ দেশের কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি আমদানি নির্ভরতাও কমে এসেছে। কিন্তু কৃষকের স্বার্থের কথা বিবেচনায় না নিলে কৃষি চাষাবাদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার বিরূপ প্রভাবে কৃষি অর্থনীতিই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে এ দফায় লবণচাষিদের যেন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে না হয়, সেজন্য লবণ আমদানির বিষয়টি সার্বিকভাবে নিরূপণ করেই সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কোনোভাবেই যেন দেশীয় লবণচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে না পড়েন, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

লেখক :আব্দু ল  হাই  রঞ্জু

সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads