লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের বোরো ব্রিধান-৯৯

সংগৃহীত ছবি

কৃষি অর্থনীতি

লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের বোরো ব্রিধান-৯৯

  • প্রকাশিত ১ ডিসেম্বর, ২০২১

মো. আবদুর রহমান

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বোরো মৌসুমে চাষের জন্য লবণাক্ততা সহিষ্ণু কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এদের মধ্যে ব্রিধান-৯৯ লবণাক্ত সহিষ্ণু একটি উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধান। এ জাতটি ব্রিধান-৬৭ এর তুলনায় অধিক লবণাক্ততা সহনশীল। লবণাক্ততার মাত্রাভেদে এ জাতটি হেক্টর প্রতি ৪.১৪-৬.৫৬ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। তাই বোরো মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় এ ধানের চাষ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

ব্রিধান-৯৯ জাতের বৈশিষ্ট্য

এ জাতের ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্রিধান-৬৭ এর তুলনায় অধিক লবণাক্ততা সহনশীল। এটি চারা অবস্থায় ১৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাছাড়া ব্রিধান-৯৯ জাতটি অঙ্গজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সকল ধাপে (Salt Sensitive Stage) ৮-১০ ডিএস/মিটার মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে সক্ষম।

পূর্ণবয়স্ক ধান গাছ ৯৪ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। ব্রিধান-৯৯ জাতের ধান গাছের ডিগ পাতা খাড়া, লম্বা ও চওড়া এবং পাতার রঙ গাঢ় সবুজ। কাণ্ড শক্ত ও মজবুত তাই গাছ হেলে পড়ে না এবং শিষ থেকে ধানও ঝরে না। এজাতের ধানের জীবনকাল ১৪৮-১৫৭ দিন। গড় জীনকাল ১৫৫ দিন। এর জীবনকাল ব্রিধান-২৮ এর চেয়ে ৯ দিন এবং ব্রিধান-৬৭ এর চেয়ে ৫ দিন বেশি। ব্রিধান-৯৯ এর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.৪ টন। তবে লবণাক্ততার মাত্রাভেদে এ জাতটি হেক্টর প্রতি ৪.১৪-৬.৫৬ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। আর উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রিধান-৯৯ জাতটি প্রতি হেক্টরে ৭.১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। ধানের আকৃতি লম্বা ও চিকন এবং দানার রং সোনালি রঙের। এক হাজার পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.৮০ গ্রাম। এধানের চালের আকার ও আকৃতি লম্বা ও চিকন, রং সাদা এবং ভাত ঝরঝরে।

চাষাবাদ পদ্ধতি

উপযোগী জমি ও মাটি : মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু প্রকৃতির এঁটেল, এঁটেল দো-আঁশ, দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি এ জাতের ধান চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

জমি তৈরি : ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এজন্য জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সেমি গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়িভাবে ৪/৫টি চাষ ও মই দিতে হবে যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। প্রথম চাষের পর অন্তত ৭ দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচনের ফলে গাছের খাদ্য বিশেষ করে অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পায়। উত্তমরূপে কাদা করা তৈরি জমিতে আঙুলের সাহায্যে ধানের চারা রোপণ সহজ হয়। তাই শেষ চাষের পর বারবার মই দিয়ে জমি সমতল করে নিতে হবে, যাতে সেচের পানি জমিতে সমানভাবে দাঁড়াতে পারে।

সার ব্যবহার : বোরো মৌসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন পেতে জমিতে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দরকার। ব্রিধান-৯৯ জাতের বোরো ধান চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ৩৬ কেজি ইউরিয়া, ১৬ কেজি টিএসপি, ১৫ কেজি এমওপি, ১২ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। জমি শেষ চাষের সময় সবটুকু টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট সার একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিত। ইউরিয়া সার সমান তিন কিস্তিতে যথা- চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম, ২৫-৩০ দিন পর ২য় এবং ৪০-৪৫ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।  ইউরিয়া সার ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে হাত দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং মাটিতে দূষিত বাতাস থাকলে তা বের হয়ে যাবে।

চারা রোপণ : ব্রিধান-৯৯ জাতের ধান ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর অর্থাৎ ১ অগ্রহায়ণ থেকে ৩০ অগ্রহায়ণের মধ্যে বীজ বপন করে বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানে তুলে এনে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মৌসুমে সারি থেকে সারি ২৫ সেমি এবং চারা থেকে চারা ২০ সেমি দূরত্বে লাগাতে হবে। প্রতি ৮-১০ লাইন বা সারির পর এক সারি অর্থাৎ ২৫-৩০ সেমি ফাঁকা জায়গা রেখে পুনরায় পূর্ববর্তী নিয়ম অনুসারে চারা রোপণ করতে হবে। এভাবে লাইন ও লোগো পর্যায়ক্রমে বজায় রেখে জমি রোপণ শেষ করতে হয়। জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছড়ানোর ওপর ভিত্তি করে এ দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে। প্রতি গোছায় ২/৩টি সুস্থ ও সবল চারা ২.৫-৩.৫ সেমি গভীরে রোপণ করতে হবে। খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়। এতে কুশি গজাতে দেরি হয়, কুশি ও ছড়া কম হয়। কম গভীরে রোপণ করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের জন্য জমিতে ১.২৫ সেমির মতো ছিপছিপে পানি রাখা ভালো। কাদাময় অবস্থায় রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যেসব জায়গায় চারা মরে যায়, সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। এর ফলে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়।

সেচ ব্যবস্থাপনা : গাছের প্রয়োজন মাফিক সেচ দিলে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। বোরো মৌসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সেমি পানির প্রয়োজন হয়। তবে কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এ সময় জমিতে দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়। ভূগর্ভস্থ অথবা নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ দিতে হবে। তবে ৩ ডিএস/মিটারের চেয়ে বেশি মাত্রার লবণাক্ততা যুক্ত পানি কখনো সেচের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। বোরো ধানের চারা রোপণের সময় ২-৩ সেমি, রোপণ থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সেমি, চারা রোপণের ১১ দিন থেকে থোড় আসা পর্যন্ত ২-৩ সেমি এবং কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত ৫-১০ সেমি পানির দরকার হয়।

ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি পর্যায়ক্রমে বের করে দিতে হবে। এছাড়া খেত থেকে মাঝে মাঝে পানি বের করে দিয়ে জমি শুকিয়ে নিতে হবে। এতে মাটিতে জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে যাবে এবং চারাগুলো মাটির জৈব পদার্থ থেকে সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারবে। তবে জমির মাটি যেন ফেটে না যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে চুল ফাটা দেখা দেয়া মাত্র পুনরায় সেচ দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেল জমি ফেটে যাবে এবং সেচের পানিও ফাটল দিয়ে চুইয়ে বিনষ্ট হবে।

আগাছা দমন : সাধারণত বোরো ধানের বেলায় চারা রোপণের পর থেকে ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ সময়ের মধ্যে অন্তত ২-৩ বার জমির আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করেই ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা উচিত। অন্যথায় আগাছার উপদ্রব বেড়ে যায়।

বিভিন্নভাবে আগাছা দমন করা যেতে পারে। যেমন- পানি ব্যবস্থাপনা, জমি তৈরি পদ্ধতি, নিড়ানি যন্ত্রের ব্যবহার, হাত দিয়ে টেনে উঠানো ইত্যাদি। নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহারের জন্য ধান সারিতে লাগানো দরকার। এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কেবল দুই সারির মাঝের আগাছা দমন হয়। কিন্তু দুই গুছির মাঝের যে আগাছা বা ঘাস থেকে যায় তা হাত দিয়ে টেনে তুলে পরিষ্কার করতে হবে। সংগৃহীত ঘাসে যদি পরিপক্ক বীজ না থাকে তবে তা পায়ের সাহায্যে মাটির ভেতরে পুঁতে দিলে পচে জৈব সারে পরিণত হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন : ব্রিধান-৯৯ জাতের ধানে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে অনেক কম হয়। তবে বোরো মৌসুমের শুরুতে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশ কম থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পোকার আক্রমণের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। বোরো ধানে সাধারণত মাজরা, থ্রিপস্, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, শিষকাটা লেদা পোকা, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া বোরো ফসলে টুংরো, ব্লাস্ট, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, খোলপচা, পাতার বাদামি দাগ ও বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের এসব রোগ ও পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

ধান কাটা : বোরো ধান সঠিক সময়ে কাটা ও মাড়াই করা উচিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরো ধান পাকে। পাকার সঙ্গে সঙ্গে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়। কারণ যে কোনো মুহূর্তে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া নিচু জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হলে এবং কাটতে দেরি করলে বৃষ্টির পানিতে অনেক সময় পাকা ধান তলিয়ে যেতে পারে। তাই পাকা ধান মাঠে না রেখে সময়মতো কেটে নিলে ফলনের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমানো যায়।

ফলন : ব্রিধান-৯৯ এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৫.৪ টন। তবে লবণাক্ততার মাত্রাভেদে এ জাতটি হেক্টর প্রতি ৪.১৪-৬.৫৬ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।

লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা

rahman.rupsha@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads