মুক্তমত

অতিমারি কোভিড-১৯

লকডাউন বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা কাম্য

  • প্রকাশিত ৬ জুলাই, ২০২১

এম এইচ খান মঞ্জু

 

১ জুলাই থেকে দেশজুড়ে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হয়েছে। বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ রয়েছে। তবে খোলা রয়েছে ব্যাংক ও উৎপাদনশীল খাত কলকারখানা। সরকার কলকারখানা চালু রাখায় শুধু অর্থনীতি নয়, স্বাস্থ্য খাতও মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। শুধু গার্মেন্ট খাত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ৪০ লাখ শ্রমিক ‘লকডাউন’ কাটাতে ছুটে যেত গ্রামের দিকে। স্বাস্থ্যবিধির বারোটা বাজানো হতো অদূরদর্শী ও অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে।

করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রসরমান অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থা ধরে রাখতে দরকার ব্যাপক হারে টিকা দেওয়া। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার পর্যাপ্ত পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে চীনা টিকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আমেরিকা থেকে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের টিকা আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আমেরিকান টিকা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে সরকার বিপুল অর্থব্যয় থেকে রেহাই পাবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এর আগে এ বিষয়ে আবেদনও জমা দিয়েছিল। ১২ থেকে ১৪ কোটি মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে দেশেও টিকা উৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করেছে। এ আবেদন বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ঢালাওভাবে সবকিছু বন্ধ করা কোনোভাবে উচিত হবে না। অর্থনীতির সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে শুধু জীবন-জীবিকা নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থেও কথায় কথায় লকডাউন জারির বদলে করোনাকালের অবসানের আগপর্যন্ত মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

আমাদের সবচেয়ে ব্যর্থতার বিষয় যে, আমরা মানুষদের সচেতন করতে পারিনি। এখনো মাস্ক পরিধান এবং বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া— এই দুটি অবশ্য পালনীয় হলেও, এক্ষেত্রে অবহেলা লক্ষণীয় সাধারণের। সামাজিক দূরত্ব যথাসম্ভব বজায় রেখে অর্থনৈতিক কর্মকা্ল পরিচালনার তাগিদ দেয়া হয়েছে বার বার। কিন্তু মানুষ যেভাবে ঘরের বাইরে হাটে-ঘাটে-মাঠে এবং সড়কে বিচরণ করেছে তাতে মনেই হয় না যে, বিশ্বে মহামারী চলছে এবং বাংলাদেশও বড় ঝুঁকির ভেতর রয়েছে। অন্যদিকে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। গত বছর মার্চে ‘ছুটি’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানুষকে ঘরে রেখে জীবন বাঁচানোর প্রথম প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। তখন মানুষ অনেকটা সিরিয়াস ছিল। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে উন্নত বহু দেশে হাজার হাজার মানুষের প্রতিদিন মৃত্যুদৃশ্য দেশের মানুষকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে মানুষ ওই ভয়ঙ্কর ভাইরাসটিকে উপেক্ষা করতে থাকে।

সাম্প্রতিককালে প্রতিবেশী দেশে ভাইরাসটির নতুন ধরন দেখা দেওয়ায় সেদেশে রেকর্ড পরিমাণ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায়। এখন করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণক্ষম ভারতীয় ধরন বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারও দ্রুত বাড়ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দিনে শতাধিক মৃত্যুদৃশ্য এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক হিসাবের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা বলেছেন, দেশে তৃতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ চূড়ায় উঠে গেছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা খালি নেই, সাধারণ শয্যারও অভাব দেখা দিয়েছে। অতীতে যেভাবে লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং মানুষ প্রায় অবাধে চলাফেরা করেছে, দোকানপাট খোলা থেকেছে; এবারের লকডাউনে তেমনটি হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন কোন সুফল আসবে না আদৌ। মহামারীর ভয়াবহ বিস্তার কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। কারণ, এবারের এই বিশেষ ধরনের ভাইরাস বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অতি উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন।

তাই মানুষের জীবন বাঁচাতে এবার চাই সর্বাত্মক প্রতিরোধ। আর সে জন্য শুরু হওয়া লকডাউনের শতভাগ সফলতা নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রশাসনের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি প্রতিটি নাগরিকেরও করণীয় রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা যে, বাংলাদেশের মানুষ আরো একবার প্রমাণ করতে সমর্থ হবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে তারা অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।

মহামারি কতটা ভয়ানক রূপ নিতে পারে, তা আমরা দেখেছি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, ভারতে এমন ভয়াবহ সংক্রমণের জন্য দায়ী যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, তা বর্তমানে বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভারতের মতো ভয়াবহ হতে পারে, যদি না কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যেই কঠোর লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। মানুষের উচিত লকডাউনকে সফল করা। একই সঙ্গে টিকা প্রদানের হার বাড়ানোও জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদকে জানিয়েছেন, টিকা পাওয়ার সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী মাসেই পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা আসবে এবং গণটিকাদান কর্মসূচি আবার ব্যাপক আকারে শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, টিকাও শতভাগ সুরক্ষা দিতে পারছে না। টিকা দেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে।

তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মধ্যে অসচেতনতা এখনো অনেক বেশি। লকডাউনের খবর শুনেই মানুষ দলে দলে ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। সামাজিক দূরত্ব মানা তো দূরের কথা, অনেকে মুখে মাস্কও পরে না। এর মধ্যে কাছে চলে এসেছে কোরবানির ঈদ। আবারো দলে দলে মানুষ ঢাকা ছাড়বে। কয়েকদিনের মধ্যেই স্থানে স্থানে গরুর হাট বসতে শুরু করবে। তাই সেসব পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে তার পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে। যেকোনোভাবেই হোক, মহামারির ভয়াবহ বিস্তার রোধ করতেই হবে।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads