মুক্তমত

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান জরুরি

  • প্রকাশিত ২৫ নভেম্বর, ২০১৯

সোহেল দ্বিরেফ

 

 

একটি উন্নয়নশীল দেশের ওপর অসহ্য বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে বরং কীভাবে বোঝাটি কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে তার বিপরীত ঘটনা। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি যখন একটু একটু করে বিশ্ব দরবারে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি বারবার বাংলাদেশের ওপর জেঁকে বসার চেষ্টা করেছে। জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বরাবরই অত্যন্ত মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাই সেই মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশকে আশ্রয় দিয়েছিল। অবশ্য গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে তাদের বৃহৎ একটি অংশের অবস্থানের দ্বিতীয় বছর ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। তবুও তাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে এখনো যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু সেটা আস্তে আস্তে এতই ভয়াল রূপ ধারণ করেছিল যে, রোহিঙ্গারা নিজ প্রাণ বাঁচানোর জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে। তবে যারা স্বেচ্ছায় পালিয়ে এসেছেন তারা কোনোরকমে জীবনটা রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু যারা সেখানে থেকে যাওয়ার অলৌকিক স্বপ্ন এঁকেছিলেন, তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে নিমিষেই! তাদের রক্তের বন্যা বয়ে যায় পুরো রাখাইনে। মানবিকতার দিক থেকে বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিলেও সেটা যেন আজ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দিন দিন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনার প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২৭০০০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তারপর একমাস অতিবাহিত হতে না হতেই সেটা পাঁচ লক্ষ হয়ে যায়। এরপর বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষে পৌঁছে গেছে। এর মধ্যেই এক লক্ষের কাছাকাছি নতুন শিশুর জন্মও হয়েছে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলেও আশানুরূপ তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। যদিও জাতিসংঘ, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব প্রদান করতে। কিন্তু মিয়ানমার সেটা আমলে নেয়নি। যদিও মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেছিল যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কার্যত এটা ছিল তাদের সান্ত্বনার কৌশলী বুলি মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। উভয় দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেক আলোচনা এবং কয়েক ধাপে বৈঠকের পর অবশেষে ২০১৮ সালের নভেম্বরে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। এর প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ সবকিছুর আয়োজনও করে রেখেছিল। কিন্তু সর্বশেষ সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়! তারপর বাংলাদেশ আবারো বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে মিয়ানমার সম্মতি দেয় চলতি বছরের ২২ আগস্টে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তবে কয়েকটি ধাপে ধাপে। তারপর অনেক যাচাই-বাছাই শেষে প্রথম ধাপে তারা ৩৪৫০ জনের একটা তালিকা দিয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ এটাও ভেস্তে গেল। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে তার কারণ অবশ্য এখনো স্পষ্ট নয়।

এদিকে মিয়ানমারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে চীন, রাশিয়া এবং জাপান। বাংলাদেশ বহুবার বলেছে, তাদের মিত্র দেশ চীন এবং ভারতকে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মিত্র দেশগুলোকে কখনোই দেখা যায়নি বাংলাদেশর পক্ষে একটা কথা বলতে। এমনকি জাতিসংঘের সর্বশেষ অধিবেশনে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। চীন বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এখন এটা পরিষ্কার যে, একমাত্র চীন ও ভারত যদি চায়, তাহলেই সমস্যাটির সমাধান সম্ভব, তা না হলে নয়। তা ছাড়া নিজ স্বার্থের জন্য চীন মিয়ানমারের পাশে থাকবে এটা স্বাভাবিক। কারণ প্রতি বছর তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে সেখানে। গত বছরও সেখানে ১৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তাদের অবকাঠামো এবং শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে রাখাইনের কিছু কিছু জায়গায় চীনা কোম্পানি তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর জন্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। মিয়ানমারের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হলো চীন। মিত্র দেশ হিসেবে রাশিয়া তাই মিয়ানমারের পক্ষেই স্পষ্ট করে বিবৃতি দিয়েছে। তবুও  বাংলাদেশকে থেমে থাকলে চলবে না। এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে চীনের মধ্যস্থতায় এ সমস্যার ইতি টানতে হবে।

বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের যে জনসংখ্যা আছে পরবর্তীতে এই সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারে। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষগুলোও খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সেখানে প্রায় ৪৬ রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে মারা গেছে, যাদের অধিকাংশ মানবপাচার এবং ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এ ছাড়া অভিযোগ আসছে, রোহিঙ্গাদের কাছে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র এবং সিমসহ মোবাইল ফোন সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এ কাজগুলো কে বা কারা করছে, তার সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। এগুলো এখনই নির্মূল করতে না পারলে, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া সবুজ পাহাড়গুলো যেন তাদের সৌন্দর্য হারিয়ে ক্রমে ক্রমেই নগ্ন হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে এই পাহাড় কাটা এবং সবুজ বৃক্ষ নিধন যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এর জন্য প্রয়োজন জোর কূটনৈতিক তৎপরতা। এই সমস্যা যত দ্রুত সমাধান হবে, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল বয়ে আনবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

shohelstat.brur06@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads