রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে পরস্পর যোগসাজশে রেলের তেল চুরি করে চলেছে একটি চক্র। দিনের পর দিন এ ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠেছে। তেল চোর সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্টেশনের আউটার কিংবা হোম সিগন্যালে ট্রেন আসামাত্রই তেল চুরি শুরু করেন চক্রের সদস্যরা। দেশের ৫০-৬০টি স্থানে প্রতিদিনই এভাবে ট্রেনের তেল চুরি হচ্ছে। যা এখন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, ট্রেনের চালক ও সহকারী চালকের যোগসাজশে ইঞ্জিনে পাইপ লাগিয়ে ড্রামে বা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্য পলিথিনে করে তেল চুরি করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনাসহ বেশ কয়েকটি রেলপথের বিভিন্ন পয়েন্টে বছরের পর বছর ধরে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল চুরি করা হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে লোকসান থেকে বের হতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
রেলের নথিপত্র থেকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে রেলের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। নির্দিষ্ট সংখ্যক বগি নিয়ে একটি ট্রেন চললে কী পরিমাণ তেল খরচ হয়, সেটার একটা হিসাব ধরে যুগের পর যুগ চলছে। মৌখিক এ হিসাবকে পুঁজি করে চোরচক্রের সঙ্গে দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে চুরি হচ্ছে তেল। আর মূলত চুরির কারণেই তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই রেলের।
এদিকে রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত এক দশকে জ্বালানি তেলের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছেও। সব মিলিয়ে একটা স্থিতিবস্থা বজায় ছিল। এর পরেও রেলের জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে তেল চুরি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, পার্বতীপুর রেলওয়ের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা, বড় জংশন, বিভিন্ন ইঞ্জিন রাখার স্থানসহ ৫০ থেকে ৬০টি স্থানে তেল চুরির ঘটনা বেশি হয়। আর মালবাহী ট্রেনগুলো দীর্ঘ সময় বিভিন্ন স্টেশনে থামিয়ে রাখার কারণে সেখানে তেল চুরির ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক সময় ডিপো থেকে তেল ইঞ্জিনে ভরার সময়ও চুরি করা হয়।
সরেজমিন কমলাপুর স্টেশনের সামনে শাহজাহানপুর ওভারব্রিজের কাছেই গিয়ে দেখা যায়, ট্রেন পরিষ্কার বা মেরামতের করা হচ্ছে। সেখানে কাজের ফাঁকে চুরি করা হয় তেলসহ ট্রেনের যন্ত্রাংশ। ঢাকার বাইরে থেকে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে আসার পর পরিষ্কার বা যন্ত্রাংশ চেক করার জন্য পাঠানো হয় সেখানে। এই সুযোগকে কাজে লাগায় কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানে কর্মরত একজন বলেন, প্রতিদিনই এখানে কোনো না কোনোভাবে ট্রেনের ক্ষতি সাধন হচ্ছে। তেল চুরি তো সাধারণ ঘটনা। চুরি করা হয় যন্ত্রাংশও।
সরেজমিন সান্তাহার লোকোশেড গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কর্মচারী একটি বালতিতে করে ট্রেন থেকে তেল নামিয়ে আনেন তাদের অফিসের বারান্দায়। তেল কী করা হবে বা কোথায় বিক্রি করা হবে তা নিয়ে কথা বলেন নিজেদের মধ্যে। এসব তেল কেনার নিজস্ব লোকও রয়েছে।
সান্তাহার রেলওয়েতে কর্মরত কয়েকজন বলেন, ‘ট্রেন থেকে তেল চুরির ঘটনা তো ওপেন সিক্রেট!’
এত বড় ঘটনা কেন ওপেন সিক্রেট জানতে চাইলে তারা বলেন, ভাই এই সান্তাহারে রেলের সম্পদের অভাব নেই। এখানকার একটা সিন্ডিকেট রেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে পারলে পুরো ট্রেনটাই বিক্রি করে দেয়।’
যেসব স্থান থেকে তেল চুরি করা হয় আবদুলপুর রেল জংশন: এখানে সান্তাহার দিনাজপুর, সৈয়দপুরগামী রাজশাহীর ট্রেনগুলো ইঞ্জিন পরিবর্তন করে রাজশাহীর দিকে রওনা হয়। এই সময় তেল চোরচক্রের সদস্যরা চালকদের যোগসাজশে ইঞ্জিন থেকে তেল নামিয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে করে পাচার করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্টেশনের পাশেই একটি বাড়িতে চোরাই তেল মজুত রাখা হয়। সেখান থেকেই পরে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হয়।
আবদুলপুর জংশনে নিরাপত্তা ইনচার্জ আবদুল হান্নান বলেন, আমি এখানে দায়িত্বে আসার পর থেকে তেল চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া কোনো অভিযোগও পাইনি। আর অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: এই রুটে চলাচলকারী প্রায় সব ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে চোরচক্রের সদস্যরা ট্রেন চালকদের সহায়তায় আমনুরা জংশন ও আমনুরা বাইপাস রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন প্রকাশ্যে রেলের শত শত লিটার তেল চুরি করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আমনুরা জংশন, আমনুরা বাইপাস রেলস্টেশন, আবদুলপুর, নাটোর, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, হিলি, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, সান্তাহার, শাহগোল্লা, আত্রাই, ঈশ্বরদী, পাকশীসহ প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি স্থানে চুরি হচ্ছে তেল।
তেল চোর চক্রের সদস্যরা বলেন, আমরা মজুরি হিসেবে তেল চুরির কাজ করি। একজন ভ্যানচালক বলেন, তেল চুরির ভাড়া মারলে টাকা একটু বেশি পাই, তাই এই কাজ করে থাকি। এ কারণে জেলও খেটেছি। তারপর থেকেই পুরোদমে এ কাজ করি।
তেল চুরির বিষয়ে রেলের পাকশী বিভাগীয় ম্যানেজার (পাবনা) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, আমরা এসবের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি। তেল চুরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দেওয়া হচ্ছে।