মুক্তমত

রেলপথ নিরাপদ রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে

  • গোপাল অধিকারী
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০

সোমবার রাতে দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে মালবাহী একটি ট্রেনের ধাক্কায় একটি ট্রাক ছিটকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। শনিবার সকাল পৌনে সাতটার দিকে জয়পুরহাট সদরের পুরানাপৈল রেলক্রসিংয়ে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পার্বতীপুর থেকে রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে বাঁধন পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের ওই সংঘর্ষ হয়। জয়পুরহাট থেকে পাঁচবিবি যাচ্ছিল বাসটি। পথে বাসটি পুরানাপৈল রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনটিও সেখানে চলে আসে। এতে সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা সবাই বাসের যাত্রী। দুর্ঘটনার পর থেকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা। নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ জনে। দুর্ঘটনার সময় রেলগেটটি খোলা ছিল এবং গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিলেন।

একটি নিরাপদ ও আনন্দদায়ক ভ্রমণের নাম ট্রেন ভ্রমণ। ট্রেন ভ্রমণ নিরাপদ ও আরামদায়ক কথাটার সাথে আমার বিশ্বাস অনেকেই একমত হবেন। কারণ বাংলাদেশে সড়কপথে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি। দেশের সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা গত নভেম্বরেও কিছুটা বেড়েছে। মাসজুড়ে সংঘটিত ৪১৭ দুর্ঘটনায় ৪৩৯ জন নিহত এবং ৬৮২ জন আহত হয়েছেন এবং ২৯টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত ও সাতজন আহত হয়েছেন। ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

ট্রেন ভ্রমণে সড়কপথের মতো নেই ভোগান্তি, নেই যানজটের ঘনঘটা, নেই দুর্ঘটনার ফুলঝুরি। যে কারণে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীর মহামারী। ট্রেন ভ্রমণের কথাটা মনে হলেই যেন মন আনন্দে নেচে ওঠে। মনে হয় পাঠ্যপুস্তকে পড়া ট্রেন ভ্রমণ ও নৌকা ভ্রমণ রচনার  কথা। পাঠের বাইরে মনে এক উৎফুল্লতা ও একটি আনন্দদায়ক ও মনোরঞ্জনের বিষয় ছিল জার্নি বাই ট্রেন। যদিও বাস্তবে ট্রেন ভ্রমণ কিছু বেদনাদায়কও ছিল। কারণ ট্রেন ভ্রমণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাইরে গ্রাম, শহর যেমন দেখা যায় তেমনি দেখা যায় দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাপন। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেন ভ্রমণে মানুষের চাহিদা বেশি বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ স্টেশনে টিকিট কাটতে শোনা যায় সিট নেই। এখন ট্রেনে কোথাও যেতে হলে আগে থেকেই টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ট্রেন যেহেতু সরকারি সম্পত্তি, একজন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমি ট্রেনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধুবাদ জানাই ও রেল মন্ত্রণালয়ের উন্নতি কামনা করি। সেইসাথে বলতে চাই ট্রেন দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। কেন ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটবে বলতে পারেন? ট্রেনপথে কি সড়কপথের মতো যানজট বা জনসমাগম আছে? ট্রেন কি মিনিটের পর মিনিটে আসে?

কিন্তু তারপরও দুঃখের বিষয় হলো, বিভিন্ন সময়ে ট্রেনের কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনা ট্রেনের সুনামকে ভূলুণ্ঠিত করে তুলছে। সামান্য ভুলে কখনো কখনো ট্রেনেও বড় দুর্ঘটনা ঘটে। একজন চালকের সামান্য ভুলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি বিশাল এই প্রতিষ্ঠানটি। এর বেশিরভাগ হয় লাইনচ্যুত হয়ে বা মুখোমুখি সংঘর্ষে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে সব মিলিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি। ইতিহাস বলে ট্রেনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টঙ্গীর কাছে মাজুখানে। এখানে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরো ৪০০ জন। ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে একটা রেল সেতু দিয়ে চলার সময় ভেঙে পড়ে। সাথে সাথে পরপর কয়েকটা স্প্যান ভেঙে পড়ে। কয়েকটি বগি নিচে শুকনা জায়গায় পড়ে। এ দুর্ঘটনায় ৬০ জন যাত্রী নিহত হন। ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে যায়। এতে ২৭ জন যাত্রী নিহত হন এবং ২৭ জন আহত হন। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারার নাশকতায় ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং নদীতে পড়ে যায়। এতে ২৫ জন যাত্রী নিহত হন এবং ৪৫ জন আহত হন। ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর  সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ৭৪৮ নম্বর আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এ সময় ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষে গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি আন্তঃনগর ট্রেনের ওপর উঠে যায়। এতে দুটি ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় দুই শতাধিক। কমিউটার ট্রেনটি জামালপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিল। টঙ্গী এসেই ঘটে যত বিপত্তি। ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। টঙ্গীর নতুনবাজার এলাকায় দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা-জয়দেবপুর রেললাইনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয় অর্ধশতাধিক। সেদিন রাত ১২টার দিকে কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের পাশে ঢাকাগামী উপবনের বগি ছিটকে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ভোররাত পৌনে ৩টার দিকে উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শতাধিক যাত্রী আহত হন। সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস এক নম্বর লাইনে ঢুকছিল। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথাকে আউটারে থাকার সিগন্যাল দেওয়া হয়। চালক সিগন্যাল অমান্য করে মূল লাইনে ঢুকে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ছোট্ট শিশু সোহার লাশ দেখে কাঁদছে সবাই। আহত ছোট্ট শিশু নাঈমা তার মা-বাবাকে হারিয়ে কাঁদছে। কী বেদনাদায়ক দৃশ্য আমরা দেখলাম! এছাড়া পাবনা এক্সপ্রেস ট্রেনচালক ছাড়া রাজশাহী পৌঁছানোসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা তো রয়েছে। যদিও পূর্বের দুর্ঘটনা তুলনায় সম্প্রতি দুর্ঘটনা কম ক্ষতির কিন্তু সময় বদলে গেছে, তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নতি ঘটেছে। তাই ডিজিটাল যুগে এমন ঘটনাও চিন্তার কারণ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে রেলপথের অনেক গেটই অরক্ষিত। নেই লোকবল কোথাও বা গেটম্যান রাখছে স্থানীয়রা। একটি ট্রেন চললে, একটি পথচারী পারাপার হলেও সেই গেটকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ একটি ছোট্ট দুর্ঘটনাই ম্লান করে দেই সব সম্ভাবনা।

সড়কে দুর্ঘটনার ঘনঘটায় ট্রেন ভ্রমণকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে বলে আমার মনে হয়। কারণ আবারো বলটি ট্রেন দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। আমার জানা মতে, সকল দুর্ঘটনার তদন্ত টিম গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে বা নিচ্ছে। তারপরও কেন দুর্ঘটনা থামছে না। জানি দুর্ঘটনা আকস্মিক। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। তারপরও বাংলাদেশ যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেয়ে দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করছে সেখানে ট্রেনে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা কি খুব কঠিন ব্যাপার? আমার মনে হয় না। হয়তো কোনো দিক কমতি আছে যে কারণে ট্রেনচালক ট্রেন না চালিয়ে অন্যকে দিয়ে চলছে। হয়তো তদন্তে ঘাটতি রয়েছে যে কারণে বাকিরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। হয়তো সাসপেন্ড করার পর আলো-ছায়ার খেলার মতো দোষী ব্যক্তি আবার স্বপদে বহাল হয়েছে যে কারণে সে তার দায়িত্ব আবারো ভুলে গেছে। সে কারণে তাকে দেখে বাকিরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সেই কারণে সরষেয় ভূত রয়েই গেছে। দুর্ঘটনার ইতিহাস পর্যালোচনা করে আইন সংশোধন বা সংযোজন করা দরকার বলে আমার মনে হয়। একজন ব্যক্তির ভুল বা অসচেতনতা যে হাজারো মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় এটা কীভাবে একজন চালক ভুলে যায়? কীভাবে ভুলে যায় তার দায়িত্ববোধ? বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা নিলে আমার বিশ্বাস ট্রেন দুর্ঘটনার বর্তমান চিত্র পাল্টে যাবে। ট্রেন ভ্রমণ আগের মতো নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে। তাই ট্রেন দুর্ঘটনার দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চাই।  নিরাপদ হোক ট্রেন ভ্রমণ।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads