• শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫ | ১৫ চৈত্র ১৪৩১ | ১৫ শাওয়াল ১৪৪৬

পণ্যবাজার

রেকর্ড মজুতেও নিয়ন্ত্রণহীন চাল

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না চালের বাজার। মন্ত্রী, প্রশাসনের দৌড়ঝাপেও কমছে না দাম। করোনা মহামারির মধ্যে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। এর উত্তাপ থেকে রক্ষা পায়নি মধ্যবিত্তরাও। অথচ সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ টনের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না।

অস্থির বাজারের লাগাম টেনে ধরতে আমদানি করলে শুধু চিকন চালের দাম কমে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু চাল আমদানিতে প্রধানমন্ত্রীর সায় মিলছে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার দাবি, বর্তমানে মোটা চালের দাম কমতির দিকে। আর এটাই আমাদের লক্ষ্য যাতে গরিব মানুষের কষ্ট না হয়।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বলছে, রাজধানীর বাজারে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে মোটা চাল। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর সরু চাল (মিনিকেট-নাজিরশাইল) বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা কেজি দরে। এক বছরে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ২০ লাখ ২ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত হচ্ছে ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। গম ২ লাখ ৭৭ হাজার; আর ধান ৪৯ হাজার টন। সরকারিভাবে চালের এত মজুত আগে কখনই ছিল না। গত বছর এই সময়ে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত ছিল ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন, যা মজুত হিসেবে ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে কম।

বর্তমান মজুত সন্তোষজনক উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আমন ধান, চাল ও গম সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং বিদেশ থেকে চাল আমদানির কারণে খাদ্যশস্যের মজুতে রেকর্ড হয়েছে। আমনের ভালো ফলন আর সবশেষ বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো চালের দাম কেজিতে অন্তত দুই টাকা করে বেড়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা; যা এক মাস আগেও ছিল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা। মুদি দোকানিরা বলছেন, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বাড়েনি। তবে পুরোনো সরু চালের দাম দুই টাকার মতো বেড়েছে।’

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তদাররা বলেন, এক মাস ধরে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের বাজার বাড়তি। গত এক সপ্তাহেও এ দুটো চালের ৫০ কেজির বস্তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নতুন মৌসুমের নাজিরশাইল প্রতি কেজি ৫৮ টাকা এবং পুরান মৌসুমের চাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে দাম বেড়েছে ২ টাকা করে।

চলতি আমন মৌসুমে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩ লাখ টন আমন ধান এবং ৫ লাখ টন সিদ্ধ আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

এরআগে গত সোমবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুতদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকিসংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রেকর্ড পরিমাণ মজুতের পরও চালের চড়া দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, গতবার আমফানে ধান নষ্ট হয়েছে। ভালো সংগ্রহ হয়নি। সর্বনিম্ন মজুত ছিল চার লাখ মেট্রিক টন। সেই সময়ও চালের দাম বাড়তে দিইনি। এবার বোরোতে যেমন বাম্পার ফলন হয়েছে, আমনেও বাম্পার ফলন। জাতীয় মজুত সর্বকালের সেরা, ২০ লাখ টনের বেশি। এখন চালের দাম বাড়ছে। এটা হাস্যকর। এখন চালের দাম বাড়াটা ভালো ঠেকছে না।

সম্প্রতি ঢাকায় ডি-৮ সম্মেলন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনেও চালের দাম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, চালের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। বাজারে চালও আছে পর্যাপ্ত। গত বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৮ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময়ে সব ধরনের খাদ্যের উৎপাদনও বেড়েছে। মোটা চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, গম ১২ লাখ টন, ভুট্টা ১৭ লাখ টন, আলু এক কোটি ৬ লাখ টন এবং পেঁয়াজের উৎপাদন এক লাখ টন বেড়ে ৩৩ লাখ টন হয়েছে।

চালের দাম বাড়ছে কেন, প্রশ্ন করা হলে কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক বলেছিলেন, দাম বৃদ্ধির বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও একটা বড় কারণ হচ্ছে সম্প্রতি গমের দাম বেড়ে যাওয়া। গমের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়ে। এখন গমের দাম চালের চেয়েও বেশি। যখন আটার দাম কম থাকে তখন মানুষ আটা খায়। এখন আটার দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ আটা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চাল খাওয়া শুরু করেছে।

তবে টিসিবির হিসাবে দুই মাস ধরে আটার দাম বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় আটার দাম বেড়েছে ২৪ থেকে ৩৮ শতাংশ। খুচরা বাজারে এখন খোলা আটা ৩৮ টাকা আর প্যাকেট আটা প্রতি কেজি ৪৫ টাকা।

এদিকে চাল ও আটার দাম লাগামের মধ্যে রাখতে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীকে মূল্য সহায়তা প্রদান এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০১২ সালে ওএমএস ব্যবস্থা চালু করে সরকার। এ ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশব্যাপী ডিলারদের দোকান ও খোলা ট্রাকের মাধ্যমে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা ও আটা ১৮ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা একবারে সর্বোচ্চ ৫ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারেন।

খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম বলেন, করোনাকালে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সরকারি গুদামগুলোতে এরই মধ্যে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত গড়ে তুলেছে। এখন আমাদের খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ২০ লাখ টনের বেশি। এই বাফার মজুত দেশে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি বাজার পর্যায়ে দাম সহনীয় রাখতে আমরা ওএমএস কার্যক্রমও জোরদার করেছি। উদ্দেশ্য এই করোনা পরিস্থিতিতে যাতে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ কম দামে চাল বা আটা কিনতে পারেন।

এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে চাপে আছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের আওতা বৃদ্ধি এবং দেশে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত কিছুটা হলেও ক্রেতা-ভোক্তার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করছেন দেশে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম জোরদার হলে বাজারে ওই পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যার সুফল ভোক্তারা পাবে। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টন চাল থাকতে হয়। এর বাড়তি থাকা আরো ভালো। খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুত দিয়ে দেশে চাল ও আটার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি যে কোনো সংকট মোকাবিলা সম্ভব।

কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, মজুত বেড়েছে, এটা ভালো। কিন্তু দাম কেন বাড়ছে, সেটার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কারসাজি করে বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দাম বাড়িয়ে দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন বাড়বে; মজুত রেকর্ড হবে; দাম কমবে না- এটা মেনে নেওয়া যায় না। লকডাউন ও করোনার কারণে পেশা হারিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের অবশ্যই কম দামে খাবার দিতে হবে।

চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, চালের দাম বাড়ার সঙ্গে মিলমালিকরা আদৌ দায়ী নন। আমরা ধান কিনে চাল উৎপাদন করি। অতিরিক্ত মুনাফা করলে আমরা দায়ী। আমরা কখনই অধিক হারে চালের দাম বাড়াই না। চালের দাম বাড়ানোর সঙ্গে আদৌ মিলাররা (চালকল মালিক) জড়িত নন। এমন অভিযোগের ভিত্তি নেই।

সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আবারো কথা কলেছেন কৃষিমন্ত্রী। এসময় তিনি স্বীকার করেছেন, চালের দাম বাড়ছে। তবে মোটা চালের দাম বাড়ছে না। ২-১ টাকা কমেছে গত কয়েক দিনে। আর চিকন চালের দাম বাড়ার দিকে।  তার মতে, তখনই সিন্ডিকেট হয় যখন সরবরাহ কম হয়। নওগাঁ-কুষ্টিয়ায় ফুড কন্ট্রোলাররা বলছে, মোটা চালের দাম বাড়ে নাই, কিন্তু চিকন চালের ঘাটতি রয়েছে। এখন আমরা কী করব।

তিনি বলেন, কিছু আমদানি করলে নিয়ন্ত্রণ হবেই। প্রধানমন্ত্রী তো করতে দিচ্ছেন না। আমদানি করলে হয়তো দাম কিছুটা কমবে। উনি (প্রধানমন্ত্রী) বলছেন, আমি তো ১০ টাকা দরে চাল দিচ্ছি, অতি দরিদ্রদের জন্য। আমি বিজিএফ, ওএমএসে চাল দিচ্ছি। গরিব মানুষের তো কোনো সমস্যা নাই। ধনীরা যারা চাল খেতে চায়, দাম দিয়ে খায়। আমার চাষিদেরও তো দাম পেতে হবে। সরু চালের দামটাই বেশি, মোটা চালের দাম কমতির দিকে। আর এটাই আমাদের লক্ষ্য যাতে গরিব মানুষের কষ্ট না হয়।

তিনি বলেন, চালের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল তো আমরা হতে পারব না। সরু চালের উৎপাদন কম। এমন উৎপাদন করতে হবে যাতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা থাকতে পারি। তবে চিকন চালের দিকে মানুষের ঝোঁক মারাত্মক। সবাই এখন চিকন চাল খেতে চায়। মোটা চাল মানুষ বিক্রি করে দেয় গরুর খাবার, পশুর খাবারের জন্য। এটা একটা সমস্যা। এত খাবার মজুত আছে; প্রায় ২০ লাখ টন। তারপর উৎপাদনও ভালো হয়েছে।

চাল ছাড়া অন্য কৃষিপণ্যের দামও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কি না জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমাদের দায়িত্ব হলো উৎপাদন করা। আমি মনে করি না ফুলকপির উৎপাদন কম হয়েছে। সারা পৃথিবীতে করোনার কারণ একটু ইনফ্লেশন হয়েছে। কন্টেইনার ভাড়া আগে যেটা ছিল তার চেয়ে বেড়েছে, এখানে ট্রাকের ভাড়া বেড়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads