আহমদ আবদুল্লাহ
বসন্তের রূপময় নিসর্গে ছুঁয়েছে বাংলার অলিগলি। ফুলের মহিরুহ সাজে সেজেছে বাংলার প্রতিকৃতি। কী অপরূপ! কী মায়ামি বাহারি ফুলের ছড়াছড়ি। মন হনন করা প্রতিক্ষণ প্রতিক্ষেত্র রঙিন করা ফুলে শোভা। মুগ্ধময় কোকিলের কুহুতানে মুখরিত হয় গ্রামীণ পাড়ি দিয়ে শহরের পথঘাট। বসন্তের সবুজ-শ্যামল নয়নকাড়া দৃশ্যপট নাড়া দেবে মনের মধ্যখানে। শীতের মায়া ছিঁড়ে এসেছে ঋতুরাজ। শুকনো পাতারা ঝরে গিয়ে জন্ম নেবে কচি নতুন পাতার। সেই পত্রপল্লবে, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর ওই পাহাড়ে অরণ্যে বসন্ত আজ দেবে নবযৌবনের ডাক। বসন্তের আগমনে নানা ফুলের গন্ধে বয়ে আনা ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ভরে যায় মন। চোখ জুড়িয়ে যায় বাগানের রক্তিম পলাশ, অশোক, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন পারিজাত, মাধবী আর গাঁদার ছোট ছোট ফুলের বাহারি রঙ্গে। রাজধানীবাসীও তাদের নগর জীবনে আজ ভিন্নরূপ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। কোটি মানুষের কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরেও মানুষ খোঁজে ফিরে আজ ফাগুনের আনন্দ মহড়া।
মহান রবের মহান সৃষ্টির অবলোকনে আলোকময় প্রতিজন। কতটা নিবিড়ভাবে সাজিয়েছেন প্রকৃতির আয়োজন। খোঁজে পাই তাতে চিন্তার খোরাক। পথাহারা আমি দিশা পাই তার প্রতিটি সৃজনে। দেখি নেয়ামতরাজির সারি সারি বৃক্ষমালা, ফুলের মায়াবি বর্ণমালা, পাহাড়ি সৃষ্টির ঝরনাধারা, আকাশে ভাসমান মেঘমালা আরো কত কী! যেমনটি ফুটে উঠে পবিত্র কোরআনে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, এরপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্মবীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্বতার প্রতি লক্ষ করে। নিশ্চয় এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্যে।’ (সুরা আনাআম, আয়াত-৯৮)
বসন্ত আমাদের মন ভুলায়, নয়ন জুড়ায়। আমাদের মনের রংধনুর রঙে-রাঙা ভাবনাগুলো ভাসিয়ে নেয় উতল হাওয়ায়। বসন্ত ঋতু একান্তভাবেই এদেশের ঋতু। এ ঋতু আমাদের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলা সাহিত্যে বসন্ত আপন রূপে-রস-গন্ধ-বর্ণ-সুষমায় ভাস্বর চিরন্তন। এ দেশের এমন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী নেই, যিনি তার শিল্পকর্মে বা লেখায় বসন্তকে স্বমহিমায় ফুটিয়ে তোলেন নি। বিদ্রোহী কবি নজরুল বসন্তকে তুলে এনেছেন কবিতা ও গানে। নজরুলের কবিতা ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত’ এর কথা না বললেই নয়। ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত। বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত। বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর, পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।
কবি নজরুল শুধু ফুল, ফাগুন আর পাখিদের মধ্যে বসন্ত এনেই ক্ষান্ত হন নি। বসন্তের করুণ বিদায়ও জানিয়েছেন তার কবিতায়- ‘বৈকালী সুরে গাও চৈতালী গান, বসন্ত হয় অবসান, নহ্বতে বাজে সকরুণ মূলতান’
বৃক্ষের শুষ্ক শাখার পল্লব কন্দরে চোখ মেলে সুগন্ধি ফুলের বাহার। মধুলোভী মৌমাছিরা মকরন্দের খোঁজে ফুলের চারপাশে গুঞ্জরণ করে। এরই ফাঁকে তারা ঘটিয়ে দেয় পুষ্পে-পুষ্পে বিবাহ, স্ত্রী ও পুরুষ ফুলের মিলন। মহান রবের সৃষ্টির কারুকার্য আমাদের ভাবিয়ে তোলে প্রতিনিয়ত, চিন্তার মাঝে ডুবিয়ে দেয় প্রতিক্ষণ। বারবার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে মহান রবের অমীয় বাণী ‘পৃথিবীর ওপর যা রয়েছে, সেগুলোকে আমি তার শোভা করেছি মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-৭) এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, শাপলা, পদ্ম, কামিনী, হিম ঝুরিসহ নাম না-জানা হরেকরকম ফুল। খাল-বিল, নদী-নালা আর বিলজুড়ে দেখা যায় সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের মিলনমেলা। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তের সাজসাজ রব। বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব ধ্বনি। এই সব মনোরম দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিকে করে পরিতৃপ্ত, স্মরণ করিয়ে দেয় কোরআনের সেই ভাষ্য ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। আল্লাহ তো অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।’ (সুরা নাহল, আয়াত-১৮) আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার জন্য তার সৃষ্টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রকাশ করতে হবে মুখে কাজে সর্বক্ষেত্রে। প্রতিটিক্ষণ কাটাতে হবে মহান রবের আরাধনায়। তাহলেই প্রকাশ পাবে অপরূপ সৌন্দর্যময় নেয়ামতরাজির যথাযথ কৃতজ্ঞতা।
লেখক : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া ঢাকা
ahmadabdullah7860@gmail.com