রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন
রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক বছরের প্রাচীন লাল ভবনটি রাজবাড়ী জেলার একটি অন্যতম পুরাকীর্তি। ১৮৭৮ সালে গোয়ালন্দ হাই ইংলিশ নামে এ স্কুলটি লাল ভবনে তৎকালীন জমিদার গিরিজা শংকর মজুমদার ও তার ভাই অভয় শংকর মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত অধিদফতর এই স্থাপনাটি সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কল্যাণ দিঘি
রাজবাড়ী শহর থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে নবাবপুর ইউনিয়নে রাজধারপুর গ্রাম। রাজধারপুর গ্রামের পাশে কল্যাণ দিঘি। বিরাট আকারের এই দিঘি বর্তমানে সমতল বিরাট বিলে পরিণত হলেও দিঘির সীমানা নির্ধারণ কষ্টকর হয় না। অনেকের মতে, দিঘিটি ১৬ খাদা জমি নিয়ে (১৬ পাখিতে ১ খাদা এবং ১ পাখি = .২৫ শতাংশ) এর অবস্থান ছিল। একসময় এ অঞ্চলে রাজা সীতারামের করতলগত হয়। রাজা সীতারাম তার রাজধানী মহম্মদপুরে (মাগুরা) অনেক দিঘি খনন করান। কল্যাণ দিঘি, রাম সাগর, সুখ সাগর, কৃষ্ণ সাগর নামক দিঘি তার কীর্তি। কথিত আছে, সীতারামের খানজাহান আলীর মতো একদল সৈন্য ছিল। তারা যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় জলাশয় খনন করে লোকের জলকষ্ট দূর করত। কথিত আছে, সীতারাম প্রতিদিন নব খননকৃত জলাশয়ের জলে স্নান করতেন। বেলগাছিতে রাজা সীতারামের খনন করা একটি পুকুর আছে।
মতান্তরে, কল্যাণ দিঘি খানজাহান আলীর কীর্তি। খানজাহান আলী ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে যশোর, খুলনা জয় করে খলিফাতাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খানজাহান আলী ধর্মপ্রচার ও জনহিতকর কাজের জন্য বহু দিঘি খনন করেন। বাগেরহাটের খানজাহান আলী দিঘি তার খনন করা অন্যতম দিঘি। খানজাহান আলী পরে পীর হিসেবে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে একদল ধর্ম প্রচারককে উত্তর পূর্বাঞ্চলে পাঠান। তার সময় এ দিঘি খনন করা এ ধারণাও বিচিত্র নয়। খানজাহান আলী ও রাজা সীতারামের খনন কাজের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। মহম্মদপুরে রাজা সীতারামের খনন করা দিঘিগুলো বাগেরহাটে খানজাহান আলীর খনন করা দিঘি থেকে আকার আয়তনে ছোট। কল্যাণ দিঘির আকার আয়তন অনেক বড়, যা খানজাহান আলীর খনন করা দিঘির মতো। দিঘি খননের সময়কাল ধরলে দেখা যায় খানজাহান আলীর খনন করা হলে তা হবে প্রায় ৬০০ বছর আগে আর সীতারামের খনন করা হলে হবে ৪০০ বছর আগে। যে কোনো দিঘি যত্নাভাবে বা অন্য কোনো কারণে তা বসে যেতে পারে। কাজেই ৬০০ বা ৪০০ বছর বিবেচনায় রেখে খানজাহান বা সীতারামের খনন কি-না তা বলা যাবে না। তবে সুলতানি আমলে কল্যাণ দিঘির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়। এ অঞ্চলের সেকআরা গ্রামে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে শাহ পাহলোয়ান ও শাহ সাদুল্লার মতো জবরদস্ত পীর আউলিয়ার আগমন ঘটে। জায়গাটি সুলতানি আমলেই মুসলিম প্রাধান্য লাভ করায় পীর আউলিয়াদের আগমন ঘটে। আর এ যুক্তিতেই অনেকে মনে করেন, ধর্মপ্রচারে উদ্দেশ্যে খানজাহান আলীর খলিফাতাবাদ রাজ্যে জনসাধারণের কল্যাণার্থে এ দিঘি খনন হতে পারে।
দৌলতদিয়া ঘাট
ব্রিটিশ আমলে গোয়ালন্দকে বলা হতো গেটওয়ে অব বেঙ্গল। লঞ্চঘাটটি দৌলতদিয়া ঘাট নামে পরিচিত। এখানে বাংলাদেশের দুটি বড় নদী পদ্মা ও যমুনার মিলন ঘটেছে। পদ্মার ইলিশের জন্যও জায়গাটি বিখ্যাত ছিল সে সময়।
শাহ পাহলোয়ানের মাজার
ষোড়শ শতকের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুদূর বাগদাদ থেকে জবরদস্ত পীর শাহ পাহলোয়ান আগমন করেন। ১৪৮০ হতে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শাহ পাহলোয়ান বোগদাদ শরীফ পরিত্যাগ করে ফরিদপুর অঞ্চলে এসে চন্দনা নদীর তীরে বাসস্থান নির্মাণ করে উপাসনা করছিলেন। এ তাপস প্রবরের প্রভাবে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার বৃদ্ধি পায়। তিনি পীর খানজাহান আলীর উত্তরসূরি ছিলেন। সেকাড়া গ্রামে তার রওজা বিদ্যমান। কথিত আছে, পীরের সম্মানে শাহ পাহলোয়ান তার কবর পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি দিতে বলেছিলেন। কারণ তার পীর সেকাড়া থেকে দক্ষিণে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তার শিষ্যরা প্রচলিত বিধানমতে যথানিয়মে তাকে কবরস্থ করলে পরদিন সকালে দেখা গেল তার কবর ঘুরে পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি হয়ে গেছে।
নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির
বালিয়াকান্দি থানার নলিয়া গ্রামে একটি জোড় বাংলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর গঠন বিচিত্র। এ মন্দিরটি ১৭০০ সালে তৈরি বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন।
গোদার বাজার ঘাট
রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদী সংলগ্ন গোদার বাজার ঘাটটি একটি ঐতিহ্যবাহী আমদানী রফতানি ঘাট। রাজবাড়ী সদর উপজেলার নদীপথে যোগাযোগের একমাত্র আমদানি ঘাট। এই ঘাটের মাধ্যমেই নদীপথে মালামাল আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে বিশাল নৌকাবাইচ হয়ে থাকে। প্রতিদিন বিকালে দর্শনার্থীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
নীলকুঠি
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর নীলকরদের অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পায় এবং প্রজাসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে সংঘবদ্ধভাবে নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় নীলবিদ্রোহ। রাজবাড়ীতে নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ সময় বালিয়াকান্দি থানার সোনাপুরের হাশেম আলীর নেতৃত্বে শত শত চাষি নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহে অংশ নেয়। বহু স্থানে নীলকুঠি আক্রমণ করে ও কাছারি জ্বালিয়ে দেয়। এ অঞ্চলের বসন্তপুর, বহরপুর, সোনাপুর, বালিয়াকান্দি, নাড়ুয়া, মৃগী, মদাপুর, সংগ্রামপুর, পাংশার নীলচাষিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার নীল কমিশন বসায় এবং নীলচাষ স্বেচ্ছাধীন ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে কৃত্রিম নীল উদ্ভাবিত হয় এবং প্রাকৃতিক নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়।
রথখোলা স্নানমঞ্চ
রাজবাড়ী শহর থেকে দুই স্টেশন পশ্চিমে প্রাচীন হড়াই নদীর তীরে বর্তমান পদ্মার কাছাকাছি বেলগাছি একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। বেলগাছির অদূরে হাড়োয়ায় স্থাপিত হয়েছে কষ্টিপাথরের মদন মোহন জিউর। মদন মোহনের মূর্তিটি পাল আমলের। বেলগাছিতে রাম জীবনের নামে গড়ে ওঠে আখড়া। রাম জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে স্নানমঞ্চ ও দোলমঞ্চের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
জামাই পাগলের মাজার
রাজবাড়ী শহরের ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আহলাদিপুর মোড়ে জামাই পাগলের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি শেড নির্মিত হয়। ১৯৬০ সালের দিকে জামাই পাগল নামে এক ব্যক্তিকে সেখানে নেংটি পরা অবস্থায় শেওড়া গাছের নিচে মাজ্জুব অবস্থায় দেখা যেত। তাকে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতেন। তার মৃত্যুর পর ওই স্থানে জামাই পাগলের মাজার নামে একটি মাজার গড়ে উঠেছে। লোকশ্রুতি আছে, জামাই পাগল এক বোবা মেয়েকে পানিতে চেপে ধরে ছেড়ে দিলে সে কথা বলতে শুরু করে।
দাদ্শী মাজার শরিফ
রাজবাড়ী শহর থেকে রেললাইন ধরে পূর্বদিকে ১ কিলোমিটার দূরে দাদ্শী খোদাই দরগা। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কামাল শাহ নামক এক আউলিয়া ষোড়শ শতকে এ অঞ্চলে আগমন করেন।। ১৮৯০ সালে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রাজবাড়ী রেললাইন স্থাপনের সময় জঙ্গলের মধ্যে দরগাটির সন্ধান মেলে। সেই থেকে দরগাটি এ অঞ্চলের মানুষ খোদাই দরগা নামে কামাল শাহ আউলিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন।
সমাধিনগর মঠ (অনাদি আশ্রম)
বালিয়াকান্দি উপজেলার জঙ্গল ইউনিয়নে ১৯৪০ সালে স্বামী সমাধি প্রকাশরণ্য এ মঠটি নির্মাণ করেন। মঠটির উচ্চতা ৭০ ফুট (গম্বুজসহ), দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ ফুট এবং প্রস্থ ৫০ ফুট। এটি অনাদি আশ্রম বলে পরিচিত। স্বামীজী এ আশ্রমের মাধ্যমে স্থানীয়দের আলোর পথ দেখিয়ে গেছেন।





