গ্যাস সংকটের সঙ্গে রাজধানীবাসীর পরিচয় বহুবছর আগে। প্রতি বছর শীতের সময় গ্যাসের চাপ কম থাকা বা দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাস না থাকার মতো ঘটনায় অভ্যস্ত রাজধানীর প্রায় সব বাসিন্দা। তবে গরমকাল এবং মনুষ্য সৃষ্ট সংকটে টানা কয়েকদিন গ্যাস না থাকার ঘটনা এটাই হয়তো প্রথম। আমিনবাজারে গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র হওয়ার কারণে কয়েকদিন ধরে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস নেই। এ ছাড়া যেসব এলাকায় গ্যাস আছে সেখানেও চাপ খুব কম। ফলে ব্যাপক ভোগান্তিতে রয়েছে বাসিন্দারা। কবে সরবরাহ লাইন ঠিক হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তিতাসের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে নতুন করে দেখা দিয়েছে এলএনজি সংকট। গত সোমবার সাভারের আমিনবাজার এলাকায় রাস্তা মেরামত করতে গিয়ে তিতাসের সিটি গেটের গ্যাসের পাইপলাইন ফুটো করে ফেলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মঙ্গলবার সকালে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর লিকেজ বা ছিদ্র শনাক্ত হয় ১২ ইঞ্চি পাইপলাইনে। তাই এটি বন্ধ রেখে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ১৬ ইঞ্চি পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এতে রাজধানীর বড় একটি অংশ এখনো গ্যাস পাচ্ছে না। যেটুকু পাচ্ছে, তা দিয়ে রান্না করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মেরামতের কাজ শেষ করতে পারেনি তিতাস। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাসের ঘাটতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল নুরুল্লাহ বলেন, আমরা মেরামতের কাজ মোটামুটি শেষ করে গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে আবার এলএনজি সংকটে কমে গেছে সরবরাহ। সরবরাহ না বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা গড়ে প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় আগে থেকে সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৯০০ মিলিয়নের মতো। আগের ঘাটতিই ৬০০ মিলিয়নের মতো। মঙ্গলবার এলএনজির সরবরাহ ছিল ৬৪০, আজ তা কমে হয়েছে ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুটে। ফলে ৬০০ মিলিয়ন ঘাটতির সঙ্গে আরো প্রায় ৭০ মিলিয়ন যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি মারাত্মক আকার নিয়েছে। সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে এলএনজি সেলের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এখন গড়ে ৬০০ মিলিয়নের মতো আমরা সরবরাহ করতে পারছি। আগামী পরশু থেকে সরবরাহ বাড়বে। ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করতে পারবো বলে আশা করছি আমরা। ধানমন্ডির বাসিন্দা মুমতাহিনা মুশতারি জানান, রাতে গ্যাস আসলেও টিমটিম করে চুলা জ্বলছে। রান্না করা যাচ্ছে না। বাইরে থেকেই খাবার এনে খেতে হচ্ছে। মোহম্মদপুর থেকে জামাল উদ্দিন জানান, গ্যাস এসেছে, কিন্তু তা দিয়ে রান্না হয় না। সকালে ১০টার পর ফের গ্যাস চলে গেছে। ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, কালকে কেরোসিনের চুলায় রান্না করে কাজ চালিয়েছি। এখন গ্যাস আছে, কিন্তু তা দিয়ে রান্না করা সম্ভব না। রূপনরগরে মঙ্গলবার একেবারেই গ্যাস ছিল না। এখন এসেছে, তবে আগুন জ্বলে টিমটিম করে। ফলে রান্না করা সম্ভব নয়। বনশ্রী এলাকার বাসিন্দারা বলেন, এমনিতেই দিনের বেলা গ্যাসের চাপ কম থাকে। গত দুদিন ধরে একেবারেই নেই। রামপুরার বাসিন্দাদেরও একই অভিযোগ।
তিতাসের জনসংযোগ শাখার পরিচালক মির্জা মাহবুব হোসেন বলেন, আমিনবাজারের একটি লাইন বন্ধ থাকলেও বিকল্প লাইন দিয়ে বেশি পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেই এলাকায় লাইনে ছিদ্র হয়েছে সেখানে নির্মাণাধীন রাস্তার কিছু মাটি ধসে পড়েছে। পানি, কাদামাটি একাকার হয়ে যাওয়ায় মেরামতে কিছুটা বেশি সময় লাগছে। শুকনো জায়গা হলে ৩/৪ ঘণ্টার কাজ ছিল। মাটি ধসে গিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। আমাদের নিজস্ব কর্মী ও কিছু ঠিকা কর্মী দিয়ে দিনরাত মেরামত কাজ চলছে। তবে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
তিতাসের দায়িত্বশীল তিন কর্মকর্তা জানান, ছিদ্র মেরামতের কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমিনবাজার থেকে ৫০০ মিটার সামনে সালেহপুর ব্রিজ এলাকায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বালু ফেলে পাইলিং করতে গিয়ে তিতাসের পাইপলাইন ছিদ্র করেছে। এখন এক্সকেভেটর দিয়ে বালু সরাতে গেলেই পানি চলে আসছে। তাই কাজ করা যাচ্ছে না। এভাবে পানির নিচে কাজ করতে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা আছে।
গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীবাসীর গ্যাস নিয়ে ভোগান্তি আরো বাড়বে। একদিকে পাইপলাইনে লিকেজ, অন্যদিকে সরবরাহ বন্ধ। সব মিলে বিপদে পড়ে গেছে তিতাস। কোনো আশা দেখাতে পারছে না তারা। তিতাসকে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে সামিট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তাই হঠাৎ দিনে ৩৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ কমে গেছে। ২৬ মার্চ সামিট আবার সরবরাহ শুরু করতে পারে।