রক্ষাকবচ সুন্দরবন

সংগৃহীত ছবি

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

রক্ষাকবচ সুন্দরবন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৬ মে, ২০২১

বরাবরের মতো এবারো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় সুন্দরবনই প্রথম প্রতিরক্ষার কাজ করবে বলে মনে করছেন বন সংরক্ষক ও পরিবেশবিদরা। এর আগে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল এবং আম্পানের মোকাবিলা করেছিল সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস যে পথ ধরে এগোচ্ছে, তাতে বাংলাদেশে আঘাত এলেও সুন্দরবন আবারো সুরক্ষা প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে। তবে পূর্ণিমার কারণে উঁচু জলোচ্ছ্বাস হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্য অতীতের মতো ফের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এগিয়ে যাচ্ছে উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে। এখন পর্যন্ত ঝড়ের যে গতিপথ, তাতে বাংলাদেশে তা সরাসরি আঘাত করবে না বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে পূর্ণিমার জোয়ারের সময় ঝড়টি উপকূলে আছড়ে পড়লে উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। তাতে আবাস হারাতে পারে সুন্দরবনের অনেক প্রাণী।

ভারতের কলকাতার আঞ্চলিক আবহাওয়া কেন্দ্র জানিয়েছে, ইয়াস আরো শক্তি বাড়িয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে আজ উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে পৌঁছাবে। তখন বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। কিছুটা দুর্বল হয়ে ঘূর্ণিঝড়টি দুপুর নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ ও উড়িষ্যার পারাদ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল পেরিয়ে স্থলভাগে উঠে আসতে পারে। তখন বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ১৬৫ কিলোমিটারে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঝড়টি বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত নাও করলেও, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব বলয়ে থাকবে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সুন্দরবনের দিকে তাকাতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, ইয়াস আঘাত হানলে সেটা সুন্দরবনের দ্বারা প্রতিহত হবে বলে আমরা আশা করছি। তবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশকে আগলে রাখতে হবে বলে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে বনে যারা জীবিকা নির্বাহ করে, মৌয়াল, জেলে এদের প্রবেশ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। নতুন করে কেউ যেন বনে ঢুকতে না পারে বা যারা বনে আছে, তারা যেন ফিরে আসে; সে নির্দেশ দিয়েছি।

দেশের বন্দরগুলোতে মহাবিপদ সংকেত জারি হওয়ায় আমরা বনকর্মীদের নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছি। প্রথম ধাপে তীব্র গতির বাতাসকে বাধা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করার কাজটি করে সুন্দরবন। সুন্দরবনে বাধা পেয়ে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের উচ্চতাও কমে আসে। তাতে বাংলাদেশের উপকূলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হবে। তবে এবার যেহেতু পূর্ণিমার সময় ইয়াস আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাই জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে।

সিডরের মতো যদি জ্বলোচ্ছ্বাস আসে, তাহলে সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হবে। অনেক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে বন্যপ্রাণীরা উঁচু আশ্রয়স্থলগুলো হারাবে। অনেক বন্যপ্রাণী হয়তো মারা যাবে। ইয়াস বাংলাদেশে বড় ধরনের আঘাত হানবে না এমন পূর্বাভাস পেলেও সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে বলে জানান এই বন সংরক্ষক।

ব্র্যাকের হিউম্যানেটেরিয়ান প্রোগ্রামের পরিচালক সাজেদুল হাসান মনে করেন, ঘূর্ণিঝড়টি কোনো কারণে গতিপথ পরিবর্তন করলে সুন্দরবন, মানুষ ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনবে। এটা সরাসরি সুন্দরবনে আঘাত হানলে বনের ক্ষতি হবে। বিভিন্ন প্রজাতির জীব-জন্তুর ওপর আঘাত হানতে পারে। কিন্তু আম্পানের মতো আরেকটু ডানদিকে ঘেঁষে খুলনা বা সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেলে এটি জনপদের ওপর আঘাত হানবে। ঘূর্ণিঝড়ে ঢাল হিসেবে মানবিক বিপর্যয় ঠেকিয় সুন্দরবন। কিন্তু বনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইয়াস যখন আঘাত হানবে, তখন পূর্ণিমা থাকবে। আর পূর্ণিমা থাকলে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস সবসময় কয়েক ফুট বৃদ্ধি পায়। এ নিয়ে আমরা চিন্তিত। ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনে আঘাত হানলে, গাছপালা নষ্ট হয়। জীবজন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবনের পাশের অঞ্চলগুলো সাতক্ষীরা, শ্যামনগরে যদি আঘাত হানে, তাহলে সেখানকার মানুষ ও অবকাঠামোর ওপর প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম-সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, এবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মতো তীব্র না হলেও এর যে প্রভাব পড়বে তা থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করবে সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতের ওপর দিয়ে চলে গেলেও আমাদের এখানে যে ঢেউটা আসবে, যে আঘাতটা আসবে; সেটা মোকাবিলা করবে সুন্দরবন। সুন্দরবনকে রক্ষাকবচ হিসেবে আমরা মনে করি।

প্রাকৃতিক এই রক্ষাকবচকে সুরক্ষার জন্য আমরা অনেক বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। রূপবৈচিত্র্যে ঘেরা, নানা প্রজাতির বনজ বৃক্ষের সমারোহে সাজানো নয়নাভিরাম সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলবাসীকে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রাচীর হয়ে রক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মানুষই বন ধ্বংস করছে নিজেদের স্বার্থে। সুন্দরবনে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ বেশি। মনুষ্যসৃষ্ট বাধার ফলে সুন্দরী, গেওয়া, গোলপাতা-এই উদ্ভিদগুলোর বেঁচে থাকা মুশকিল।

শ্বাসমূল যেহেতু ওপরে থাকে, সেখানে বেশি মানুষজন হাঁটাচলা করলে গাছগুলোর ক্ষতি হয় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গাছ কাটা, পোড়ানো, মানুষের বিচরণ, জালের আঘাত, নৌকার আঘাতেও শ্যাওলা-গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের অতিরিক্ত বিচরণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয় দাবি করে এই পরিবেশবিদ বলেন, সুন্দরবনে বিচরণের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই আমাদের সুন্দরবনে যেতে হবে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়,  দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলজুড়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই বনে ১৯৮৯ সালে সুন্দরী গাছ ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর। এছাড়া নদীভাঙনে কমেছে ১৪ হাজার হেক্টর বনভূমি।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads