মানুষকে সুখে-শান্তিতে দুনিয়ায় বসবাস করার জন্য নবী (সা.) আল্লাহ প্রদত্ত কোরআন মাজিদের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান। কোরআন মাজিদে এসেছে, ‘কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ (সুরা বাকারাহ : ১৮৫) কিন্তু মানুষ তা পুরোপুরি মানছে না। ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে দিন দিন ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। নিজ হাতেই কামাই করছে নিজেদের ধ্বংস। নিজেকে নিজে ধ্বংস করার জন্য পৃথিবীজুড়ে এ যেন এক মহা উৎসবের আয়োজন করেছে। বিশ্বব্যাপী সুশৃঙ্খল সমাজকে ধ্বংস করাই যেন এখন মানুষের দায়িত্ব। করে চলছে গোনাহের কাজে প্রতিযোগিতা। আর বিভিন্ন আজাব-গজব আসছে গোনাহের প্রতিফল স্বরূপ হিসেবেই। কোরআনের ভাষায়- ‘জলে ও স্থলে যেসব বিপদ সংঘটিত হয়, সব মানুষের হাতের কামাই করা।’ (সুরা রূম : ৪১) উল্লিখিত আয়াতে কারীমার শিক্ষানুযায়ী আরোপিত বিপর্যয়ই আমাদের কর্মের প্রতিফল।
মানবজাতির গুনাহের প্রতিফলস্বরূপ যেহেতু বিপর্যয় আসে সেহেতু যেসব গোনাহে যেসব বিপর্যয় আসে সে সম্পর্কে বিশ্বনবি (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ৫টি ভয়ানক ব্যাপার হতে আল্লাহ তোমাদেরকে হেফাজত রাখুন। সে ৫টি কাজ হলো— ১. নির্লজ্জতা শুরু করলে প্লেগসহ এমন রোগ দেখা দিবে যা কখনও পূর্বপুরুষগণ দেখেনি। ২. ওজন কম দিতে শুরু করলে দুর্ভিক্ষসহ অত্যাচারী শাসকের শোষণ দেখা দিবে। ৩. জাকাত বন্ধ করা শুরু করলে রহমতের বৃষ্টি হতে বঞ্চিত হবে। যা পশু পাখি না থাকলে একফোঁটাও বর্ষিত হতো না। ৪. ওয়াদা ভঙ্গ করা শুরু করলে বিভিন্ন দুশমন তাদের ওপর জয়যুক্ত হয়ে ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করে নিবে। ৫. জিনাকে জায়েজ কাজের ন্যায় প্রকাশ্যে এবং শরাব পান ও গান-বাদ্য শুরু করলে আল্লাহপাক অসন্তুষ্ট হয়ে ভূমিকম্প শুরু করার আদেশ দেন। (ইবনে মাজাহ)
বিপর্যয়ের কারণ উল্লেখপূর্বক বিশ্বনবী (সা.) আরো কিছু বিষয় আমাদের অবহিত করে গেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খিয়ানত করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না), জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু তার মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসক রূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি জনগণের নেতা হবে, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারীশিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হয়ে যাবে, মদ পান করা হবে (বিভিন্ন নামে মদ ছড়িয়ে পড়বে), শেষ বংশের লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময় আসবে যখন তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে তখন একটি ভূমিকম্প সেই ভূমিকে তলিয়ে দিবে (ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে বা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে)।’ (সহিহ তিরমিজি) দেশে এখন সুদের ব্যাপকতা এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার পাপকে কিছুই মনে করা হচ্ছে না। বাহ্যিকভাবে দেখা যায় সুদ গ্রহীতারা সম্পদের পাহাড় জমাচ্ছে। কিন্তু সে সম্পদ কিছুতেই তাকে সুখ দিতে পারে না। অপরদিকে গ্রহীতারা সুদের চাপে পিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত ভিটে-মাটিহীন হয়ে পরছে। তাই বান্দাকে সতর্ক করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহপাক সুদের মাল নিশ্চিহ্ন করে দেন।’ (সুরা বাকারা : ২৮৬)
কারো মনে হতে পারে যে, সুদের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আসলে পার্থিব জীবনেই সুদের সম্পদকে আল্লাহতায়ালা নিশ্চিহ্ন করে দেন। যেমন- সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়া, অযথা খরচ বেশি হওয়া ইত্যাদি। সম্পদ নিশ্চিহ্ন হওয়ার আরেকটি দিক হলো— সুদখোর তার উপার্জিত সম্পদ থেকে উপকৃত হতে পারে না। যার কারণে সুদের পরিণামে দেশে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, যে সম্প্রদায়ের মাঝে সুদের প্রচলন বৃদ্ধি পায় তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। (মুসনাদে আহমাদ)
ওয়াদা রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু তা না করে অহরহ ভঙ্গ করে চলছে এ ওয়াদা। যে কারণে ক্ষতি হচ্ছে অপরপক্ষ। তাই আল্লাহর হাবিব (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল অতঃপর তা রক্ষা করল না।’ (মুজামুল আওসাত, তারিখে দিমাশক)
লেখক : আলেম ও শিক্ষক





