যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ

ছবি : সংগৃহীত

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধ

যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ

  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

১৯৭১ মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের স্মৃতি। ইতিহাসের রাখাল রাজা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশের।

এই দেশ, এই মাটি, আর এই মাটির মানুষকে ভালোবেসে সেদিন বাংলার যেসব দামাল ছেলে যুদ্ধ করতে গিয়ে অসময়-অবেলায় তাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, জাতি তাদের আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। বিজয়ের মাস এলেই শহীদদের কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে। মনের অজান্তেই শহীদ আত্মারা তাদের রেখে যাওয়া প্রিয় স্বজনদের দুয়ারে এসে কড়া নেড়ে যায়, তখনই হূদয়ে শুরু হয় রক্তক্ষরণ।

‘সব কটা জানালা খুলে দাও না                         

আমি গাইব গাইব বিজয়ের গান

যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেল প্রাণ’...

১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার টানে প্রিয় জন্মভূমিকে মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যারা বিভিন্ন সময়ে শহীদ হয়েছেন— আমরা তাদের অনেককেই চিনি, আবার অনেককেই চিনি না। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এদেশের অনেক দামাল ছেলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে যায় এবং ট্রেনিং শেষে দেশে এসে জন্মভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে যুদ্ধ শুরু করেন। আর যেসব দেশপ্র্রেমিক ব্যক্তি ভারতে যেতে না পারলেও দেশে বসে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন, তাদের অনেকেই সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। আমরা তাদের কী মনে রেখেছি?

মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার উমেদপুর ইউনিয়নের চরকাচিকাটা গ্রামের মরহুম শহীদ জসীম উদ্দিন খান ও আবদুল লতিফ খান তেমনই দুজন। আবদুল লতিফ খান পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি করতেন। ছোট ভাই এএইচ আবদুল মান্নান খান তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা এবং ১৯৬৫ সালে বরহামগঞ্জ কলেজের ভিপি ছিলেন, পরবর্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শিবচর উপজেলায় প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। এই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান খানকে ধরার জন্য সেদিন পাক সেনাবাহিনী হঠাৎ খানবাড়িতে হানা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান খানকে না পেয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং বাড়িতে থাকা তার দুই সহোদর জসীম উদ্দিন খান এবং আবদুল লতিফ খানকে বাড়ির ওপর স্বজনদের সামনে গুলি করে মেরে রেখে যায়। শিবচর থানার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারাই প্রথম শহীদ হন। অথচ তাদের নাম আজ আর কেউ মনে রাখে না।

এদের মতোই আরেকজন হলেন উমেদপুর ইউনিয়নের রামরায়েরকান্দি গ্রামের অধিবাসী সমাজসেবক দেশপ্রেমিক স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র রাহা। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন খুব সাদামাটা দেশপ্র্রেমিক মানুষ। তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি পানের ব্যবসা করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর সাহায্য সহযোগিতা এবং আশ্রয় দিতেন। এই সংবাদ রাজাকার আলবদর বাহিনী পাকসেনাদের কাছে পৌঁছে দিলে পাকবাহিনী সুধীর চন্দ্রের বাড়িতে হামলা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং তাকে ধরে নিয়ে প্রথমে বেয়নেট চার্জ করে আহত করে এবং পরবর্তীতে বাড়ির অদূরে রাস্তার ওপর গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। মৃত্যুর পর তার স্বজনরা তার মৃতদেহের সৎকারও সঠিকভাবে করতে পারেনি। যে স্মৃতি তাদের স্বজনদের আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। বিজয়ের মাস এলেই জাতীয় পতাকার দিকে শুধু নির্বাক নয়নে চেয়ে থাকেন। জাতীয় পতাকাই যেন তাদের বাবার দেওয়া উপহার। এ দেশের আনাচে কানাচে এমনি আরো হতভাগা শহীদরা রয়েছেন যাদের খবর কেউ রাখে না।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহীদদের নামে রাস্তঘাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত শহীদদের খাতায় এদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়নি। দেশমাতৃকার জন্য তারা তাদের অমূল্য জীবনকে উৎসর্গ করে আমাদের চিরঋণী করে গেছেন। কিন্তু বিবেকের কাছে আজ বড় প্রশ্ন, এই সকল শহীদের আমরা জাতি হিসেবে কী দিলাম?

মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের জন্য গত ১০ বছরে বিগত সরকার অনেক পরিকল্পনাই গ্রহণ করেছে। সদ্য শেষ হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের যথার্থ মূল্যায়নের সচেষ্ট ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। নতুন সরকার এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আজ এই বিজয়ের মাসে একটাই আবেদন জসীম উদ্দিন, আবদুল লতিফ কিংবা সুধীর চন্দ্রের মতো নাম না জানা অসংখ্য শহীদের খুঁজে বের করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অসহায়ভাবে নির্বাসিত সেসব শহীদ পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করুন। তাদের ন্যূনতম জীবন ধারণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে কিছুটা হলেও ঋণ শোধ করি। বিজয়ের মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

খন্দকার জেহানুল হক

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads