মুক্তমত

ম্রো জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রতিবেশ ও পর্যটন উন্নয়ন

  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন

 

 

সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে, একটি কল্যাণ সংস্থা ও সিকদার গ্রুপ বান্দরবানে একটি পাঁচ তারকা হোটেল এবং পর্যটন স্থান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বান্দরবানে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠী অভিযোগ উত্থাপন করেছে, এই প্রকল্পটির মাধ্যমে স্থানীয় প্রায় এক হাজার একর জুমের জমি দখলের চেষ্টা করা হয়েছে (দ্য ডেইলি স্টার, ৮ নভেম্বর ২০২০)। অভিযোগটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটি সত্যিই একটি অমানবিক, অনুচিত এবং উন্নয়নবিমুখ উদ্যোগ।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের ট্যুরিজম শিল্পের অবকাঠামো, সেবা ও মান আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বহুদূরে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের আগমনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করার মতো নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারত এদিক থেকে খুব এগিয়ে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের সুনাম রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো ভারতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অস্তিত্ব। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একটি দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রয়েছে, যা স্থানীয় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।

দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করার জন্য উন্নত মানের হোটেল ও কটেজ নির্মাণ করা ট্যুরিজম শিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কোনোভাবেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাকে অগ্রাহ্য করে নয়; তাদের বসতভিটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়; পরিবেশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে নয়, স্থানীয় পরিবেশের প্রতি তাদের আবেগকে অবমূল্যায়ন করে নয় এবং সাংস্কৃতিক ও জীববৈচিত্র্যকে অস্তিত্বহীন করে নয়। যে-কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প বা অবকাঠামো অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বৃদ্ধি ও গতিশীল করে। কিন্তু তা যদি মানুষের সাংস্কৃতিক শিকড়কে ধ্বংস করে দেয়, তাহলে তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয় এবং সে ধরনের উন্নয়ন মোটেই টেকসই নয়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে বিশেজ্ঞরা বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানী, উন্নয়নবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পরিববেশ বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে বলে এসেছেন যে স্থান ও পরিবেশের সাথে মানুষের আবেগ এবং অস্তিত্বের সম্পর্ক আছে। এসব অ-অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোর প্রতি আক্রমণ মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্ত্তিত্বকে বিপদাপন্ন করে তুলে। তাই যে-কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময় অ-অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে। একইভাবে বান্দরবান পাহাড়ে কোনো ধরনের পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের আগে উল্লিখিত অ-অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা উচিত।

বান্দরবান পাহাড়ে বসবাসরত স্থানীয় ম্রো জাতিগোষ্ঠীকে যদি স্থানচ্যুত করে বিলাসবহুল হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় তাহলে এটি হবে রাষ্ট্রের সম্মুখে ব্যক্তিমালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ। সাধারণত, ট্রাইবাল বা ইন্ডিজিনাস জাতিগোষ্ঠীরা স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদকে ঘিরে তাদের নিজস্ব জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ঐতিহ্যবাহী স্থানের সাথে মানুষের ভাষা, আচরণ, দর্শন, আবেগ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক ভিত্তিগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু মুনাফানির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এসব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে বড় বড় স্থাপনা তৈরিতে গুরুত্বারোপ করে। এই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নের ফলাফল নির্দিষ্ট সংখ্যক গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক হলেও তা সার্বিকভাবে মান কল্যাণের জন্য ক্ষতিকর।

প্রতিবেশের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য পৃথিবীর বহু স্থানে লক্ষ করা যায়। সামাজিক বিজ্ঞানীরা মানুষ ও পরিবেশের মধ্যকার এই জটিল পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন ‘রাজনৈতিক প্রতিবেশ’ তত্ত্ব দ্বারা। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে এবং কী কী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবেশ বা পরিবেশের ওপর কর্তৃত্ব খাটায় এবং কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদে অসম প্রবেশাধিকার ও অসম নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয় যা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। বৈষম্যের ফলে সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে বিভেদ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়।

শুধু বান্দরবান নয়, যে-কোনো স্থানেই স্থানীয় মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীকে গৃহহীন ও ভূমিহীন করে সেখানে বিলাসবহুল হোটেল ও পর্যটন স্থান নির্মাণ টেকসই উন্নয়নের উদাহরণ হতে পারে না। উন্নয়ন (যেমন পর্যটন, শিল্প-কারখানা বা বিদ্যুৎকেন্দ্র) বাস্তবায়নের যে ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট স্থানের বাসিন্দাদের মতামত এবং সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে যেন অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিকীকরণ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার না করার সুযোগ পায় সে দিকে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads