এ কোন মোস্তাফিজ? প্রশ্নটা ক্রিকেট ভক্তদের। বাইশ গজে বিস্ময়রূপে আবির্ভূত ছেলেটা এখন যেন আপাতদৃষ্টিতে দলের বোঝা। সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘গলার কাঁটা’। বিগত দুই বছরে অচেনা এক ফিজকে প্রত্যক্ষ করেছে পুরো ক্রিকেট দুনিয়া। আদ্যোপান্ত বিবেচনায় বিস্তর ফারাক শুরুর ‘কাটার মাস্টার’ আর আজকের ফ্লপ ফিজের।
ক্যাপটেন ফ্যান্টাসিক খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজা কর্তৃক এদেশের পেস বোলিং বিপ্লবের অন্যতম সেনানী হিসেবে নিজের জানান দেন ফিজ। তবে বিধি বাম! বর্তমানে সেই সৈনিকই আজ রণকৌশল বেমালুম ভুলে নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতেই বসন্ত দেখে ফেলা ফিজের ওপর কোনো এক অজানা কারণে ক্রিকেট বিধাতা হলেন রুষ্ট। হাসলেন বাঁকা হাসি, বেজার হয়ে ফিরিয়ে নিলেন মুখ।
এদিকে, দেশের জার্সিতে মাঠ মাতানো ফিজের সামনে একে একে আসতে থাকল সব গগনচুম্বী অফার। খেলতে লাগলেন বিদেশি সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। তার ধারাবাহিকতায় সুযোগ মিলল আইপিএলেও। প্রথম আসরেই করলেন বাজিমাত! তার দল হায়দরাবাদের মাথায় উঠল চ্যাম্পিয়নের মুকুট। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’ সাকিবের পরে টাইগার ক্রিকেটের মুখপাত্র হিসেবে আইপিএলে উঁচিয়ে ধরলেন লাল-সবুজের ঝান্ডা। অভিষেকেই ঝলক দেখানো ফিজ পরের আসরে খেলার সুযোগ হলো ‘ক্রিকেট গড’ খ্যাত শচীনের দল মুম্বাইয়ে। খ্যাত নামা সব কোচ পরামর্শকদের অধীনে জ্ঞানার্জন হলেও পারফরম্যান্সটা হলো না আহামরি!
তবে কোথায় হারালেন কাটার মাস্টার? উত্তর হলো বেরসিক ইনজুরি। সাদামাটা আইপিএলের সঙ্গে যোগ হলো ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ রূপে বাম কাঁধের ইনজুরি। অবশ্য এই বিষয়ে আপসহীন ছিল বিসিবি। নিজস্ব অর্থায়নে ফিজের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে তার বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
ক্যারিয়ারের ভাটা শুরু হয় মূলত এখান থেকেই। কালো মেঘ জমে তার ক্রিকেট ক্যানভাসে। একটা সময় কাটার, স্লোয়ার, ইয়র্কারসহ সবকিছুই ছিল তার নখদর্পণে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রগুলোতে পড়েছে মরিচা। সদ্য সমাপ্ত ভারত সিরিজে রঙিন পোশাকে বিবর্ণ ফর্মের কারণে সুযোগ পাননি সাদা পোশাকে। এমনকি ঐতিহাসিক গোলাপি বলের টেস্টেও মাঠে ছিলেন দর্শক হয়ে।
ইদানীং ভ্যারিয়েশনের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না তার বোলিংয়ে। গত দুই বছরে ব্যাটসম্যানদের উদার হস্তে রান উপহার দিয়ে চলেছেন। ফলশ্রুতিতে তার ইকোনমি সাতের ওপর, যেটা সত্যিই দৃষ্টিকটু। প্রিমিয়ার একজন বোলারের কাছে থেকে এমন শ্রীহীন বোলিং কোনো দলেরই কাম্য নয়। এতে করে এবার চটেছেন খোদ বিসিবি বসও।
তবে, নিজের এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স নিয়ে নিজেও স্বস্তিতে নেই ফিজ। ছন্দবিহীন ক্যারিয়ারে পুনরায় ছন্দ ফেরাতে বিপিএলকেই আদর্শ মঞ্চ ভাবছেন ‘সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস’। বিপিএল নিয়ে কাঠখড়ও পুড়িয়েছেন বেশ। ছুটে বেরিয়েছেন একের পর এক অভিজ্ঞদের দ্বারে। করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম!
তবে, এবারের বঙ্গবন্ধু বিপিএলে রংপুরে সুযোগ পাওয়া এই পেসার ঢাকা পর্বে হারিয়ে খুঁজেছেন নিজেকে। শেষমেশ ভাগ্যদেবী কিছুটা হলেও সহায় হয়েছেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। সাগরিকায় স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিয়েছেন বেশ শক্ত ঢঙেই। ধরাশায়ী করেছেন লেন্ডল সিমন্স, মুক্তার আলীর মতো হিটারদের। চট্টগ্রাম পর্ব শেষে ৫ ম্যাচে মোস্তাফিজের উইকেট মাত্র ৬টি। ৫ ম্যাচে রংপুর ম্যাচ জিতেছে একটি। সেই ম্যাচেই মোস্তাফিজকে দেখা গেছে নিজস্ব ঢঙে। ৪ ওভারে রান দিয়েছেন ২৩। একটি মেডেন। উইকেট দুটি। তার মানে একটা জিনিস পরিষ্কার, মোস্তাফিজ ঝলসে উঠলেই সেই দলের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
এরই মাঝে আইসিসির থেকে মিলেছে এক সুসংবাদ। ২০১৯-এ সেরা উইকেট শিকারিদের তালিকায় ৩৪ উইকেট নিয়ে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছেন তিনি। এতে কিছুটা হলেও তলানিতে ঠেকা আত্মবিশ্বাসের গ্রাফটা কিছুটা হলেও ওপরের দিকে ঊঁকি দিচ্ছে।
তবে, হতাশার সাগরে নিমজ্জিত মোস্তাফিজ খড়কুটোর মতো পাশে পাচ্ছেন সতীর্থ মুশফিকুর রহিমকে। সদ্য এক বিবৃতিতে মুশফিক বলেন, ‘ও (ফিজ) একজন চ্যাম্পিয়ন বোলার। আমি যদি কোনো ম্যাচে অধিনায়ক থাকি আর বিপক্ষ দলের যদি শেষ ওভারে ৪ রানের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি ওর হাতেই বল তুলে দেব। আশাহত হওয়ার কিছু নেই, সে শীঘ্রই স্বরূপে ফিরবে।’
মুশফিকের মতো সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী থেকে এদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদেরও একই স্বপ্ন। তবে, এরই মাঝে নিজের ক্ষোভ এবং হতাশার কথা জানিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। তিনি জানান, ‘ক্রিকেট বিশ্বে মোস্তাফিজের আবির্ভাব ঘটেছিল বিস্ময় রূপে, তবে দিনে দিনে তার সাদামাটা বোলিং তাকে স্থান করে দিয়েছে বিরক্তির নামের তালিকায়। ওর শিগগিরই নতুন কিছু অস্ত্র সংযোজন অর্থাৎ বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনা আবশ্যক, নাহলে মোস্তাফিজ হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে। এদেশের ক্রিকেটে সে হয়ে উঠবে একটি আক্ষেপের নাম।’
মোস্তাফিজের এই বিচ্যুতি চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে সবার মনেই। উৎকণ্ঠিত স্বয়ং ফিজও। কিন্তু সবার প্রত্যাশা মোস্তাফিজ দ্রুতই ফিরবেন স্বরূপে। যা খুব দরকার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য।
লেখক: বিপ্রতীপ দাস