ফাল্গুনে দৃশ্যমান হয় বাংলার রূপ। প্রতিটি ঋতুই অপার মহিমা আর নিজস্ব সৌন্দর্যে ছড়ায় প্রশান্তি। তবে বসন্তের জানা-অজানা নানা ফুল, ফল ও পত্র-পল্লব গ্রামীণ নিষ্প্রাণ মূর্তিকে করে দৃশ্যমান। মেঠোপথের পাশে অবহেলা অনাদরে ফোটা তেমনি একটি ফুলের নাম ভাটফুল। বাতাবি লেবু আর আমের মুকুলের গন্ধের মতো এ সময় মেঠে পথের পাশে ফোটা দেশি এই ভাটফুল গ্রামীণ পরিবেশে আনে নতুন জীবন, দেয় ভিন্ন রূপ। সৌন্দর্য আর চিত্তহরী সুবাসের প্রমাণ ছড়িয়ে এক অজানা মাদকতায় বিমোহিত করে পথিককে ঘুঙুরে এ ভাটফুল।
ভাটফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ঈষবৎড়ফবহফৎঁস ারংপড়ংঁস. ওহভড়ৎঃঁহধঃঁস প্রজাতির এই ভাটফুল ঠবৎনবহধপবধব গোত্রের খধসরধপবধব পরিবারের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ঝোপ জাতীয় গাছে তোড়ার মতো ফুটে থাকা বহুপুষ্পক মঞ্জরী এই ফুলের রং সাদা। পাপড়ি পাঁচটি। ঠিক যেন তুলিতে টানা ফুলের মাঝখানটায় বেগুনি রঙে ছাপ। সাদা পাঁচটি দীর্ঘ কেশর। পতাঙ্গপরগী এই ফুল ফাল্গুনে ফোটা শুরু হয়। ফুলের ব্যাস ১ ইঞ্চি। বয়স্ক গাছ মোটামুটি শক্ত হলেও ৩-৫ ফুট উচ্চতার গুল্মজাতীয় নরম এই গাছের বেড় ১-১.৫ ইঞ্চি হতে পারে। এক পক্ষল বিষাক্ত তেঁতো পাতার রং সবুজ। উইয়ের ডিবি, পরিত্যক্ত ভিটা, সড়ক কিংবা মেঠোপথের দু’পাশে, বেড়ার গায়ে অবহেলা অনাদরে গাছ বেড়ে ওঠা এই ভাটফুল বিভিন্ন অঞ্চলে বনজুঁই, ঘেটু, ভাইটা, ভাটি, ভাট ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
মৃত স্বামীর প্রাণভিক্ষায় দেবসভায় নৃত্যরত বেহুলার পায়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ পরিয়ে দিয়েছিলেন ভাটফুলের নূপুর। তাই ভাটফুলকে সাহিত্যরসিকরা আবার বাংলার বেহুলা কিংবা বাংলার নূপুর নামেও চিনে থাকেন। নীরবে সৌন্দর্য ছড়ানো এই ফুলটির নাম সংস্কৃতিতে ঘণ্টাকর্ণ। রাতে গন্ধ ছাড়ায় এই ফুল। প্রকৃতিপ্রেমীরা মনে করেন কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ ফাগুনে প্রকৃতিতে আগুন লাগায়। আমের মুকুল, বাতাবি লেবু সুগন্ধি ছড়ায়। গ্রামীণ মেঠো পথের পাশে ফোটা ভাটফুলের গন্ধ আর সৌন্দর্য নীরবে চিত্তহরী মাদকতা ছড়ায়। কাছেও টানে। ঘুঙুরে এ ফুল শিশু কিশোরী খোঁপায় কিংবা কানে গুঁজে আনন্দও পায়। আধ-ফোটা ফুলের কেশর পানিতে ফেললে পানির ওপর কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকে বলে গ্রামের শিশুদের খেলার সামগ্রী হতেও দেখা যায় এ ফুল।
দেশের সব অঞ্চলেই দেখা মেলে ভাটফুলের। গাছ হয় ফুলের বীজ থেকে। ওষুধি ও ভেষজগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় গ্রামের লোকজন এ গাছটিকে ঔষধি গাছ হিসেবেও চিনে থাকে। জ্বর, চর্মরোগ, ভিমরুল কিংবা বিচ্ছুর হুল ফোটানোয় ভাটফুলের পাতা, ফুল, ফল ও মূল ব্যবহার করা হয়। অনেকে দাঁত ব্রাশে মেছওয়াক হিসেবেও এ গাছের গোড়ার অংশ ব্যবহার করেন। চৈত্রসংক্রান্তিতে এই ভাটফুলের আরাধনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
‘সেভ দি বার্ড অ্যান্ড বি’ নামে পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ক স্থানীয় সামাজিক সংগঠনের পরিচালমণ্ডলীর একজন দুবাই প্রবাসী মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘নির্বিচারে বনজঙ্গল গাছপালা কেটে ফেলায় দিন দিন পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বয়িক আবহাওয়ার পরিবর্তনে প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় এসব অঞ্চলে। ভাটফুল একটি সামাজিক উদ্ভিদ। চার-পাঁচ ফুট দীর্ঘ এই ভাটফুলের গাছ ঘনঝোপ তৈরি করে। ভাটফুলের জঙ্গল বিলুপ্তপ্রায় বনবিড়াল, মেছোবাঘ, বেজি, গুইসাপ, সজারু, শেয়াল, উদবিড়ালসহ নানা প্রাণীর আশ্রম। এরা অন্যকোনো ঝোপ-ঝাড়, লতা-পাতা কিংবা গাছপালার সঙ্গে বিরোধও করে না। এ জাতীয় ঝোপ-ঝাড় গাছপালা কেটে ফেলার কারণে প্রকৃতি হারাচ্ছে সৌন্দর্য। সঙ্কটাপন্ন হচ্ছে প্রাণিকুল।