মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুসলমানদের মুখে উচ্চারিত হয় ‘ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’। আবার কারো মুখে এ আয়াত শোনা মাত্রই আমাদের বিবেক তথ্য দেয় যে, কেউ একজন মারা গেছেন। অতঃপর আমরা মৃত ব্যক্তির জন্য আফসোস করি, তার কর্মের হিসাব মিলাই, ব্যবসার গতিবেগ ভাবি, সম্পদ ও অট্টালিকার কথা চিন্তা করি এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। কথা হলো আয়াতের মূলমন্ত্র কি! অন্যের মৃত্যু সংবাদ দেয় নাকি নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ কথাটিতে দুটো বাক্য আছে। প্রথমত, ‘ইন্না লিল্লাহি’, এর অর্থ আমরা তো আল্লাহরই। দ্বিতীয়ত, ‘ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’, আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। দুটো বাক্যই গভীর মর্ম ও ব্যঞ্জনার ধারক, যার উপলব্ধি মুমিনের বুকে আনে প্রশান্তি ও নির্ভরতা আর তার হূদয়ে জাগিয়ে দেয় এক পবিত্র প্রত্যাশা। আয়াতাংশদ্বয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা আল্লাহর সৃষ্টি, মাবুদের নিকট হতে আমরা এ দুনিয়ায় আগমন করেছি আবার মাবুদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। ‘আমরা তো আল্লাহর’ কথাটিতে আছে এক অপূর্ব সমর্পণ এবং অদ্ভুত অন্তরঙ্গতা। আরবী ভাষা হিসেবেও বাক্যটির ভাব ও ব্যঞ্জনা এমনই। আরবী ভাষাবিদ মনীষীগণ এ বাক্যের তরজমা করেছেন এভাবে-আমরা তো আল্লাহর অর্থাৎ তাঁর মাখলুক ও সৃষ্টি, মামলুক ও দাস।
পৃথিবীতে মালিকানা বলে একটা কথা আছে। বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা, কলকারখানা, কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, এসোসিয়েটসহ আরো কত কিছুরই মালিকানা রয়েছে। এই পার্থিব মালিকানার রয়েছে নানা সূত্র। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, হেবা, দান, উইল, মিরাস ইত্যাদি। এই যে মালিকানার নানা সূত্র, এগুলো তো সর্বজনস্বীকৃত। আর এই স্বীকৃতির ওপরই চলছে পৃথিবীর সব কাজ-কারবার। অথচ দৃষ্টিপাতের বিষয় হলো এইসব সূত্রের কোনোটাকেই বলা যায় না, শূন্য থেকে সৃষ্টি। শুধুমাত্র আল্লাহর সৃষ্টিই হলো হলো শুরু থেকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করেন, তখন তিনি বলেন, হও! আর সাথে সাথেই তা হয়ে যায়। ‘ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এই কথাটিতে আছে আখিরাতের প্রতি মুমিনদের ঈমানের ঘোষণা। পৃথিবীর নানা অবস্থা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। এখানের সুখও ক্ষণস্থায়ী, দুঃখও ক্ষণস্থায়ী। বিপদে আক্রান্ত হলে বুঝে আসে, পৃথিবীর সুখ কত অসার! পাবার প্রত্যাশা ও হারাবার বেদনার মাঝে বাস্তব সুখ কত ক্ষণিকের! স্বজন-প্রিয়জনের মৃত্যু স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবন কত ক্ষণস্থায়ী! কত দ্রুত অপসৃয়মান। এই তো ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে এবং ‘সময়’ আসছে। হজরত উমর (রা.)-এর বিখ্যাত বাণী, ‘প্রতিদিন ঘোষণা হয় অমুক মারা গেছে, অমুকের ইন্তেকাল হয়েছে। একটি দিন তো অবধারিত, যেদিন বলা হবে উমরের মৃত্যু হয়েছে।’
বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি ‘কোভিড-১৯, (করোনা)’ সকাল-সন্ধ্যা আমাদের সেই ক্ষণস্থায়ী জীবন, চিরসত্য মৃত্যু ও চিরস্থায়ী পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মৃত্যু সম্পর্কে চমৎকার উপস্থাপন পেশ করেন, ‘প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’। আর অবশ্যই কেয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন শুধুই ধোঁকার সামগ্রী।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৮৫) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-৭৮) সুরা জুমুআর ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালাতে চাও, সেই মৃত্যুর সঙ্গে অবশ্যই তোমাদের সাক্ষাৎ হবে। তারপর তোমাদের সেই মহান আল্লাহর কাছে ফেরত পাঠানো হবে, যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব বিষয় জানেন এবং তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।’ সুরা আল মুলকে ইরশাদ হয়েছে, ‘যিনি জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তিনি তোমাদের যাচাই করে নিতে পারেন যে, কর্মক্ষেত্রে কে তোমাদের মধ্যে উত্তম।’ আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা (মানুষের) মৃত্যুর সময় তার প্রাণায়ু বের করে নেন, আর যারা ঘুমের সময় মরেনি তিনি তাদেরও রুহ বের করেন অতঃপর যার ওপর তিনি মৃত্যু অবধারিত করেন তার প্রাণবায়ু তিনি (ছেড়ে না দিয়ে রেখে দেন) এবং বাকি (রুহ)-দের একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ছেড়ে দেন; এর (ব্যবস্থাপনার) মধ্যে এমন সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। যারা (বিষয়টি নিয়ে) চিন্তা-ভাবনা করে।’ মুমিন ব্যক্তি কারো মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণে আনেন, নিজের আমলের হিসেব করেন, জাহান্নামের ভয়ে কাবু হয়ে যান।
মৃত্যু সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, ‘মৃতের সঙ্গে তিনটি জিনিস কবর পর্যন্ত যায়। এর মধ্যে দুটি ফিরে আসে এবং একটি থেকে যায়। যে তিনটি কবর পর্যন্ত যায় তা হচ্ছে, মৃতের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন, মাল-সম্পদ ও আমল। কিন্তু পরিবার পরিজন ও মাল-সম্পদ ফিরে আসে এবং আমল কবরে থেকে যায়।’ (সহিহ বুখারি) এদিকে কীভাবে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু লাভ করা যায় সে সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারাই মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে, তাদের সঙ্গে আল্লাহর নিগূঢ় সম্পর্ক তৈরি হয় এবং আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করে। ফলে তাদের জন্য ঈমানি মৃত্যুলাভে সহায়ক হয়। পৃথিবীর এক চিরন্তন সত্য ‘মৃত্যু’। এ মৃত্যু নামক শব্দটি কারো জন্য প্রচণ্ড ভয়ানক আবার কারো জন্য সফলতার মানদণ্ড। দুনিয়ার জীবন থেকে আখেরাতের চিরস্থায়ী ঠিকানায় যাওয়ার অন্যতম মাধ্যমও এটি। মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সতর্ক করতে আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘তোমরা দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ অথচ পরকালীন জীবনই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা : আয়াত ১৬-১৭)
সর্বসাধারণ ইন্না লিল্লাহ দ্বারা অন্যের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে থাকে। আর মুমিনগণ ইন্না লিল্লাহ শোনার সাথে সাথেই নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে। সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণকারী ব্যক্তি কখনো আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় না। মৃত্যুর কথা স্মরণকারী ব্যক্তির গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ জীবনে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট হতে পারে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে একটি মিনিটও অযথায় ব্যয় হয়নি। যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক পদ্ধতি ছাড়া কেউ উঁচু স্তরে পৌঁছাতে পারে না। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে মৃত্যুর কথা স্মরণপূর্বক সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে, যথাযথভাবে সময়কে কাজে লাগাতে হবে। মৃত্যুর স্মরণ কোনো দুঃখপূর্ণ বা নেতিবাচক বিষয় নয় বরং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ। মৃত্যুর স্মরণ সব সময় নিজের কর্মকাণ্ডের হিসাব গ্রহণ, গুনাহ থেকে তাওবা করা, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
তাই আমাদের কর্তব্য হলো, সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা এবং বেশি বেশি তওবা করা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা করো, আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদের এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে ঝরনাসমূহ প্রবহমান।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত-৮) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২২২)। ‘(হে নবী) আপনি বলুন, (আল্লাহ বলেন) হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের সত্তার প্রতি সীমাহীন জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা জুমার, আয়াত-৫৩)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসো, নিশ্চয় আমি প্রতিদিন ১০০ বার তওবা করি।’ (সহিহ মুসলিম) তিনি আরো বলেন, ‘সকল আদম সন্তানই গুনাহগার, গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তওবাকারীরা।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, দারেমি) তওবার সুফল সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘গুনাহ থেকে তওবাকারী, বেগুনাহ ব্যক্তির মতো।’ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি) তওবা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কখন কিভাবে কার মৃত্যু হবে কেউ জানে না। তাই সব সময় তওবা-ইস্তিগফারে থাকা। আল্লাহ আমাদের গুনাহ মুক্ত করে ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করুন। আমিন।
লেখক : সংগঠক ও প্রাবন্ধিক
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
tohaarafat1998@gmail.com