বিশ্বব্যাপী আধুনিক সভ্যতার যত আবিষ্কার আজ দৃশ্যমান, প্রায় সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্যে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা সভ্যতার বিকাশকে করেছে আরো গতিশীল ও বেগবান। রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস- সর্বত্র ছিল তাদের অগ্রণী পদচারণা। বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবন বলেন, ‘লন্ডনের রাস্তা যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকত তখন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল তীর্থকেন্দ্র কর্ডোভার রাজপথ আলোয় উদ্ভাসিত থাকত।’ আরেকজন ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আরবরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি এবং সভ্যতার আলোর বাতিকাধারী ছিল। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান এবং দর্শন পুনর্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয়। যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ ঘটে। মৌলিক গবেষণা এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার সংরক্ষণে তারা অসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।’ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মূল্যবান আবিষ্কারের ফলেই আজ বিশ্ববাসী আধুনিক ও উন্নত জীবন ধারণ করতে সমর্থ হয়েছে। নিচে মুসলমানদের কিছু বিস্ময়কর আবিষ্কার তুলে ধরা হলো—
কফি : এমনও মানুষ আছেন, যাদের এক কাপ কফি পান না করলে সকাল হয় না। প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ক্যান্টিন বা কফিশপে কফি পান তো আছেই। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ১৬০ কোটিরও বেশি কাপ কফি বিক্রি হয়। এর মধ্যে ইউরোপ আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি কফি বিক্রি হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই কফির প্রথম আবিষ্কারক ইউরোপ বা আমেরিকার কেউ নন। নবম শতকের দিকে ইয়েমেনের মুসলমানরা প্রথম কফি চাষ ও উৎপাদন শুরু করে। আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন সুফিরা ইবাদত করার জন্য রাত জাগতেন। প্রথম প্রথম কফি পান করেই সুফিরা রাত জেগে থাকতেন। এরপর একদল শিক্ষার্থীর মাধ্যমে মিসরের রাজধানী কায়রোয় এসে সেই কফি পৌঁছায়। ক্রমে সেখানেও কফি চাষ শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে কফি উৎপাদন ছড়িয়ে পড়ে।
হাসপাতাল : হাসপাতাল আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। কারণ আমরা অনেক সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হই। রোগমুক্তির জন্য প্রয়োজন হয় উন্নত চিকিৎসার। আর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন চিকিৎসক ও হাসপাতাল। একসময় বিশ্বের কোথাও এমন কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না, যেখানে সাধারণ মানুষ সরাসরি গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারত। মানুষের কল্যাণের জন্য হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন আহমদ ইবনে তুলুন। তিনি ছিলেন তুলুনিদ সাম্রাজ্যের একজন শাসক। তিনি ৮৭২ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোয় সর্বপ্রথম ‘আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাগদাদে আরো নতুনভাবে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে হাসপাতাল ব্যবস্থা চালু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় : সারা বিশ্বে এখন যত নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং এগুলো থেকে যত ডিগ্রি বা সনদ প্রদানের আয়োজন রয়েছে- এসবের মূলে রয়েছে মুসলিমদের অবদান। কারণ বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ এবং সনদ প্রদানের কার্যক্রম সূচিত হয়েছে মুসলিমদের হাত ধরেই। আফ্রিকা মহাদেশের মরক্কোয় ৮৫৯ সালে প্রিন্সেস ফাতেমা আল ফিরহি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ইতিহাস বলে, সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরবর্তীকালে প্রিন্সেস ফাতেমার বোন মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পুরো কমপ্লেক্সটির নাম হয় ‘কারুইয়িন বিশ্ববিদ্যালয়’।
বীজগণিত : বিজ্ঞানের মূলকাঠি হলো গণিত। গণিতবিদ্যার ওপর ভিত্তি করে স্কলাররা বিশ্বময় গর্ব করে বেড়ান। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই গণিতের জনক কে? সর্বপ্রথম গণিতের ধারণা দেন হজরত দাউদ (আ.)। এক, দুইয়ের গণনা তারই চিন্তার ফসল। এমনিভাবে বীজগণিতের প্রথম আবিষ্কারকও একজন মুসলিম। তিনি হলেন পারস্যের বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজম। সর্বপ্রথম তিনি বীজগণিতের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর সপ্তম শতকে তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবলা’। তার রচিত এই বইটি থেকেই মূলত এই শাস্ত্রের নাম হয় অ্যালজেবরা। আল-খোয়ারিজম রচিত বীজগণিতের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক গণিতের যাত্রা ও পথচলা শুরু।
চশমায় পরিবর্তন : চশমার ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন মুসলমানরা। বসরা নগরীর বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আলহাজেন সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন, চোখের গঠনপ্রণালি এবং চোখ কীভাবে কাজ করে। তিনিই প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ করেন, চোখের দৃষ্টিরশ্মির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অনুভূতি নেই। এ ছাড়া তিনিই প্রথম চশমার ধারণা দিয়ে বলেন, বাঁকানো কাচের পৃষ্ঠতল চোখের দৃষ্টি সহায়ক হিসেবে বিবর্ধনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।