ফিচার

মুখোমুখি হুমায়ূন ও হিমু

  • বাসার তাসাউফ
  • প্রকাশিত ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

বাংলা সাহিত্যে লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তায় যার নাম প্রথমে, যিনি সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু বলয় থেকে বাংলাদেশি পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের দিকে, বিশেষ করে নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই অনন্যসাধারণ লেখক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কিছু লিখতে আমি কলম নিয়ে বসিনি। ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে শুরু করার পর ‘দেয়াল’ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি সাহিত্যকর্মই পাঠকপ্রিয়তায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাকে। কী জাদু ছিল তার লেখায়? এর নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে? হুমায়ূন আহমেদের নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে যে নামটি মনে পড়ে যায়, সেটি হলো ‘হিমু’ এবং এ নামটি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে হলুদ পাঞ্জাবি পরা খালি পায়ে হেঁটে চলা ভবঘুরে এক যুবকের ছবি। যতদূর জানি, হুমায়ূন আহমেদের লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গস্পর্শের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে হিমু, শুভ্র, মিসির আলী ও রূপা নামের জনপ্রিয় কিছু চরিত্র। এসব চরিত্রের মধ্যে ‘হিমু’র জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি।

হিমু চরিত্রের আসল নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিল তার বাবা। হুমায়ূন আহমেদ হিমুর বাবাকে বর্ণনা করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে, যার বিশ্বাস ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায়, তবে একইভাবে মহাপুরুষ তৈরি করাও সম্ভব। মহাপুরুষ তৈরির জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরি করেছিল সে, যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। হিমুর পোশাক ছিল পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি। হলুদ বৈরাগের রঙ বলেই পোশাকের রঙ হলুদ নির্বাচন করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। প্রায়ই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়াও অন্যদের বিভ্রান্ত করে এবং এরকম করা তার অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ। প্রেম-ভালোবাসা উপেক্ষা করা হিমুর ধর্মের মধ্যে আছে। কখনোই কোনো মায়া তাকে কাবু করতে পারেনি। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে উধাও হয়ে যায়। তাকে সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না, আবার অস্বীকার করা যায় না তার প্রবল মানবিকতাকেও। সে একইসঙ্গে আনন্দাচ্ছন্ন, আবার বিষাদজড়িত। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে কখনো তা করে না।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসের মাধ্যমে হিমুর আবির্ভাব ঘটে। সেখানে প্রবল দুর্দশা এবং অসচ্ছলতার ভেতর থেকে এক টুকরো সুখ খুঁজে নিতে হিমুকে কল্পনার ময়ূরাক্ষীর তীরে চলে যেতে দেখা যায়। ইচ্ছে হলেই যে কোনো সময় সে নদীতীরে ভ্রমণ করতে পারে, চাইলে যে কাউকে সঙ্গেও নিয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেখানে তার মাকেও দেখতে পায় হিমু। এ উপন্যাসটিতে দেখা যায় হিমুর বাবা প্রায় বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ, যে ছেলেকে ‘মহাপুরুষ’ বানানোার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মহাপুরুষ বানানোর কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারার আশঙ্কায় হিমুর মাকে হত্যাও হয়তো সে-ই করে। ঘটনাক্রমে জীবনের একটা সময় এমনও এসেছিল যখন হিমুকে তার পিশাচসম মামাদের সঙ্গে বসবাস করতে হতো। সেখানে সে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়। এভাবেই হিমু সিরিজের সূচনা হয়েছিল। 

বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে হিমু। এ যেন অদ্ভুত এক বাধ্যতা! বাবার দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী সব সময় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় এবং পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি তার নিয়মিত পোশাক হয়ে যায়। হিমুর বাবার মহাপুরুষ বানানোর প্রয়াস হিমুকে কতটুকু মহাপুরুষ করতে পেরেছিল তা জানা যায়নি। তবে হিমুকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করেছিল। হিমুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হিমু ২৫-৩০ বছর বয়সী অনাড়ম্বর একজন যুবক। তবে অনাড়ম্বর হলেও তার মধ্যে বেশকিছু উদ্ভট আচরণ ছিল যা সাধারণ থেকে তাকে করেছে আলাদা। কারো কাছে সেটা বিরক্তিকর আর কারো কাছে একদমই মহাপুরুষ! হিমুর একটি বিশেষ গুণ হলো, যে কোনো পরিস্থিতিতেই সে স্বাভাবিক থাকতে পারে এবং খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। সুন্দর করে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় কথা বলাও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এসব হাস্যরসের মাঝে শহুরে ভণ্ডামির নানান দিক ফুটে ওঠার পাশাপাশি মানবজীবনের অন্তর্লীন বিষাদগ্রস্ততার চিত্রও খুব সহজে ধরা দেয়। এ কারণে অনেক সময় হিমুকে অকর্মা যুবকও মনে হতে পারে। কিন্তু সে কখনো অন্যের অনিষ্ট করে না এবং দিন শেষে প্রতিটি উপন্যাসেই হিমুকে নিঃস্বার্থ এবং পরোপকারী হিসেবে দেখা যায়।

হিমু হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে হিমুর বাবার পর সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে হিমুর বান্ধবী রূপা। হিমুকে পছন্দ করে রূপা, হয়তোবা ভালোও বাসে। হিমুও যে রূপাকে অপছন্দ করে, তা নয়। মাঝে মাঝে রূপাকে কোনো এক দোকান থেকে ফোন করে নীল শাড়ি পরে তাদের বারান্দায় দাঁড়াতে বলে হিমু। রূপা তাই হিমুর জন্য অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু হিমু আসে না। রূপা তারপরও অবাক হয় না। বরং সে হিমুকে তার মেসে চিঠি পাঠায়, চিঠিতে একটুখানি অনুযোগ থাকে শুধু, আর কিছু না। এ জন্য হিমুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই মহাপুুরুষগিরি ছেড়ে-ছুড়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেটা করা হয়ে ওঠে না। কারণ হিমুদের আবেগ গায়ে মাখতে নেই, হিমুদের ভালোবাসতে নেই। হিমুরা কাউকে ভালোবাসে না।

হিমুরা কাউকে ভালো না বাসলেও অজস্র পাঠক হিমুকে ভালোবাসে। তাই তো হিমু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই এখনো হিমু হওয়ার চেষ্টা করছে। আর এটাই হিমু চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ। কেননা হিমু শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। অনেকেই তাই হিমু হতে চায়! কিন্তু হিমুর স্রষ্টা আমাদের থেকে বিদায় নেওয়ায় হিমুর জীবনযাপনও যেন স্থির হয়ে আছে। তাই হিমুর খালি পায়ে পরা হয়নি জুতো। হলুদ পাঞ্জাবিতে যুক্ত হয়নি পকেট। হিমুস্রষ্টার প্রস্থান হয়েছে, কিন্তু হিমুর বিনাশ ঘটেনি, থেমে আছে হিমুর নগ্ন পায়ে পথচলা। তবে এখনো বাড়ির ছাদে বিষণ্ন বদনে, উদাসী নয়নে অপেক্ষার আনন্দ উপভোগ করে নীল শাড়িপরা রূপা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বেশি প্রিয়? হুমায়ূন আহমেদ নাকি হিমু? হুমায়ূন আহমেদের এমন গগনস্পর্শী জনপ্রিয়তার নেপথ্যে হিমু চরিত্রের যে অনেক বড় ভূমিকা আছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হিমুকে নিয়ে যে পাঠকের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক তরুণ এখনো হিমুকে অনুসরণ করে, হিমুর মতো হতে চায়। কিন্তু কেউ হুমায়ূন আহমেদ হতে চায় না। আজ হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই, কিন্তু তার সৃষ্ট চরিত্ররা বেঁচে আছে। হুমায়ূন আহমেদ আর হিমু পাঠকের কাছে এক অপার ভালোবাসার নাম। দুজনেই পাঠকের মনের কোণে বহুদিন বেঁচে থাকবে এ কথা অকপটে বলে দেওয়া যায়। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads