অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী
চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় দুইশ’ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ মুখ গহ্বরে দৃষ্টিগোচর হয়। বর্তমানকালের মরণঘাতী রোগ এইডস থেকে শুরু করে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হূদরোগ এমনকি গর্ভাবস্থায় অনেক রোগের লক্ষণ মুখের ভেতরে প্রকাশ পায়।
যেমন একটি রোগীর মুখ পরীক্ষা করে যদি দেখা যায়, তার মাড়িতে তীব্র প্রদাহ রয়েছে, মাড়ি ফুলেছে, তাতে পুঁজ জমা হয়েছে, মাড়ি থেকে দাঁত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং সামান্য আঘাতে রক্ত বের হয়ে আসছে, তবেই তাকে আমরা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ বা মাড়ির রোগ হিসেবে বলতে পারি। অনেক ক্ষেত্রে এসব রোগীর ইতিহাস নিয়ে দেখা যায় যে, কয়েক বছর যাবত তাদের ডায়াবেটিস এবং তারা নিয়মিতভাবে ইনসুলিন নেন। এসব রোগীকে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন থেকে একটি সুন্দর বই দেওয়া হয়, তাতে তার একটা মোটামুটি ইতিহাস পাওয়া যায়। যেমন- তার রক্তচাপ, অন্যান্য রোগের উপস্থিতি, খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় উপদেশ এবং নিয়মিতভাবে তার রক্তের শর্করা পরীক্ষার ফল। দেখা যায় প্রতিমাসেই তার শর্করা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং প্রায়ই রক্তের শর্করা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি। জেনে রাখা প্রয়োজন রক্তের শর্করার স্বাভাবিক পরিমাণ হচ্ছে অভুক্ত অবস্থায় ৬.৪ মি. মোল এবং খাবার দু’ঘণ্টা পর ৭.৮ মি. মোলের কম। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব ডায়াবেটিক রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন না তাদেরই মাড়ির রোগের প্রদাহ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ অধিকমাত্রায় লক্ষণীয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদেরই এই রোগ বেশি হবে।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যাদের মুখে ডেন্টাল প্লাক রয়েছে এবং জিনজিভাইটিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিসের কারণে মুখের এবং মাড়ির রোগ আরো বেড়ে যায় এবং প্রদাহ আরো তীব্রতর আকার ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে দাঁতগুলো পড়ে যায় এবং ফেলে দিতে হয়। তা ছাড়া আরো একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, মাড়ির প্রদাহের কারণেই ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না এবং রক্তের শর্করাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। সুতরাং ভালোভাবে খাদ্যদ্রব্য চিবিয়ে খাওয়ার জন্য যেমন সুস্থ মাড়ি ও দাঁতের প্রয়োজন, তেমনি ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মাড়িকে প্রদাহমুক্ত বা সুস্থ রাখা প্রয়োজন। মুখের আরো একটি বিশেষ রোগ মুখের ঘা। মুখের এই ঘা নানা কারণে হতে পারে। যাদের বিভিন্ন রোগ রয়েছে যেমন- ডায়াবেটিস, হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, রিউম্যাটিক, রক্তস্বল্পতা, ক্যানসার, এইডস ইত্যাদি।
বিশ্বের প্রথম যে এইডস রোগীটিকে শনাক্ত করা হয় তার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ধরা পড়ে মুখের ঘা, যাকে বলা হয় হেয়ারি লিউকোপ্লাকিয়া। যাদের ডায়াবেটিস বা হূদরোগ রয়েছে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং দীর্ঘদিন যাবত ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের মুখে এক ধরনের জীবাণু বিস্তার লাভ করতে পারে। যেমন- তাদের মুখে ক্যানডিডা জীবাণুর কারণে ক্যানডিয়াসিস হতে পারে।
আরো যেসব ঘা হতে পারে সেগুলোর মধ্যে লিউকোপ্লাকিয়া, লাইকেন প্লানাস ইত্যাদি রয়েছে। যারা নিয়মিতভাবে অন্যান্য রোগের চিকিৎসার সঙ্গে ওষুধ খান তাদের মুখেও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা রোগ প্রতিরোধক শক্তি কম হওয়ায় মুখের ঘা সাময়িকভাবে দেখা দিতে পারে, যা ওষুধ বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই নিরাময় হতে পারে। যেমন গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায় মাড়ির প্রদাহ দেখা যায় এবং গর্ভপাতের সঙ্গে সঙ্গেই তা নিরাময় হয়। তবে এটি সাধারণত হয় হরমোনের তারতম্যের কারণে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মাড়িতে প্লাক জমা রয়েছে কি না, যদি থাকে তবে তা অবশ্যই স্কেলিং করিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। মুখে আরো একটি ঘা সব বয়সেই হতে পারে এর নাম ‘এপথাস আলসার’। বিশেষ কোনো (বি) ভিটামিন স্বল্পতা, কোনো দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা মুখের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদির কারণে এপথাস আলসার বেশি হয়। অনেক সময় এই ঘা আরো প্রকট হয়ে দেখা যায়, তবে উপযুক্ত সময়ে এই ঘায়ের চিকিৎসা করাতে পারলে ভালো। এই রোগের চিকিৎসা হলো দুশ্চিন্তা দূর করা, ঘুম যাতে স্বাভাবিক হয় তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া এবং এক ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় মলম ব্যবহার করলে স্থানীয়ভাবে ওই স্থানে লেগে থেকে ঘা টিকে তাড়াতাড়ি শুকাতে সাহায্য করে। আরো একটি কারণে মুখের ঘা দেখা দিতে পারে, সেটি ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের ধারালো অংশ ক্রমাগতভাবে যদি জিহ্বাতে অথবা গালের মাংসে ঘষতে থাকে, তবে ওই স্থানে ঘা হতে পারে। তা ছাড়া কৃত্রিম দাঁত, ক্রাউন বা মুকুট, ফিলিং মেটেরিয়াল ইত্যাদির ধারালো অংশের ঘর্ষণেও ঘা হতে পারে।
সুতরাং প্রয়োজন হবে খুব তাড়াতাড়ি ওইসব ধারালো দাঁতের চিকিৎসা করা। যেমন ধারালো দাঁতকে যদি ঘষে একটু মসৃণ করে দেওয়া যায় অথবা কৃত্রিম দাঁতের ধারালো অংশকে যদি ঘষে দেওয়া যায় তবেই নিরাময় সম্ভব। এর জন্য বিশেষ কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি আমাদের দেশে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতে (বিশেষত ভারতে) গবেষণায় দেখা যায় যে, যাদের ধূমপান এবং জর্দা, পান ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে, তাদের মধ্যে মুখের ঘা খুব বেশি হয় এবং সেই সঙ্গে মুখের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তবে যাদের রক্ত পরীক্ষার পর ভিটামিন স্বল্পতা পাওয়া যাবে, তাদের সেই ভিটামিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া যেতে পারে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)
মুখ ও দন্ত রোগ বিশেষজ্ঞ
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা)