শত বছরের নিপীড়িত জাতিকে মুক্তির আলোয় আলোকিত করেছিলেন যে মহানায়ক, তিনি বঙ্গবন্ধু। যার এক ডাকে শত সহস্র জনতা ভয়কে করেছিলেন জয়। বাস্তবিকভাবে বর্তমান সমাজে আলোর মাঝেও লুকিয়ে আছে অন্ধকারের ছায়া, যা দূরীকরণে প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধতা। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অতীতকে হূদয়ে ধারণ করে আগামীর পানে স্বপ্ন দেখতে পারলেই হয়তো সম্ভব দুরবস্থা থেকে উত্তরণ। প্রয়োজন একজন মুজিবের। পারব কি আমরা মুজিব হয়ে উঠতে? নানা লড়াই সংগ্রাম, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মুজিবের বাংলায় উদযাপিত হয় মুজিব শতবর্ষ ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সুস্থ পথে চালিত হওয়া প্রজন্ম সবারই প্রত্যাশা মহান নেতার সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। সৃষ্টিশীল কাজে বাংলাদেশ এগিয়েছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ হয়তো নেই। শিক্ষা, দীক্ষা, গবেষণাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অগ্রগামী এক সময়কার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। বিশ্ব নতুনভাবে এ দেশকে চিনছে। বারবার সোনার সন্তানরা দিচ্ছে সক্ষমতার প্রমাণ। তবু স্বাভাবিকতার মাঝে অস্বাভাবিকতা ঘুণ পোকার মতো আঁকড়ে ধরে নষ্ট করছে চলমান গতিধারাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আজো ৫০ বছর পরে এদেশে দেশদ্রোহী অপশক্তি সদা তৎপর। মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু শব্দগুলোর ওপর যাদের তীব্র আক্রোশ। অর্থের বিনিময়ে যারা প্রতিনিয়ত বিপথে চালিত করছে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর তরুণদের। স্পর্শকাতর বা আবেগময় বিষয়গুলোর অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত করছে তরুণ প্রজন্মকে। নষ্ট করছে জাতির সুস্থতার ধারাকে। তাই, জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শের প্রশ্নে আপসহীনতার জায়গাটা সৃষ্টি করতেই হবে। অপশক্তিকে পদানত করে মূলধারায় আনতে হবে জাতির আগামী দিনের সম্পদদের। রাষ্ট্রীয় ‘কমন আইডিওলজি’ হতে হবে সুস্পষ্ট। ক্ষমতার পালাবদলে যেন না বদলায় ইতিহাসের নির্মম সত্যতা সে বিষয়ে সবাইকে হতে হবে সচেতন। মনে রাখতে হবে, সোনার বাংলা গড়তে সুস্থ পথে চালিত সোনার সন্তানদের আগে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সুপথে রাখতে পারলেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব। যতই বাধা আসুক তারাই এগোবে, প্রয়োজনে যুদ্ধ হবে আরেকবার।
ধাপে ধাপেই দূর হয় জাতির আগাছা। একদিনেই শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। তাই মনে রাখতে হবে একবারেই দূর হবে না চলমান দুরবস্থা। অমানুষেরা দেখতে তো মানুষের মতোই হয়, তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই সহজ কিছু নয়। তবে ধীরে ধীরে নিজ অবস্থান থেকে শুরু করা যেতেই পারে। ধর্ষণ, খুন, অবাধ মাদক ব্যবসা, অবৈধ টেন্ডারবাজি, বেপরোয়া কিশোর গ্যাং আশপাশের ঘটনাগুলো ভেবে দেখুন একসময় তুচ্ছভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে অথচ সময়ের সাথে সাথে বিরাট রূপ নিয়েছে। সুতরাং প্রতিরোধের জায়গাটাও তুচ্ছভাবেই শুরু করতে হবে। সেটাই একদিন প্রতিরোধের মহাস্পৃহা হয়ে রুখে দাঁড়াবে অপরাধের দরজা। মহানায়েকরা রুখে দাঁড়ানোর পথ তৈরি করে দেয় মাত্র। বাস্তবে লড়তে হয় সাধারণ মানুষকেই। থাকব কি আমরা আরেকজন মুজিবের প্রত্যাশায়? নাকি নিজেরাই হয়ে উঠব ভয়ডরহীন একজন মুজিব, যার পানে চেয়ে পথ দেখবে পুরো তরুণ সমাজ। অনেকে হয়তো বলবেন ‘সাময়িক ইস্যুতে সৃষ্ট’ নব্য কিছু রাজনৈতিক নেতার কথা। যারা হুট করে জাতীয় নেতা বনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে নিজ স্বার্থে। যারা আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে নিয়মিত প্রশ্নবিদ্ধ করছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত চেতনা বা মুজিব আদর্শের সমসাময়িক দিকপালদের। নিজেরাই নিজেদের গায়ে লাগিয়ে নিচ্ছে তথাকথিত ‘গণবন্ধু বা ছাত্রবন্ধু’ উপাধি। সামনে সুস্থতার ভান, আড়ালে অসুস্থতার কালো ছায়ায় যারা ধ্বংস করছে তরুণ প্রজন্মকে। তাদের মতো স্বার্থান্বেষীদের হাত ধরে মুজিবের বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা মহান নেতার আদর্শের অবমাননাস্বরূপ! ‘লেফাফাদুরস্থ’ মনোভাব নিয়ে কখনোই তার আদর্শের উত্তরসূরি হওয়া সম্ভব নয়। দিলখোলা সরলমনে যা বিশ্বাস করতেন মুজিব তা-ই বলতেন। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এগিয়ে চলা ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক আদর্শিক চর্চার অংশ। কোনো দূতাবাস বা বিশেষ ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের অংশবিশেষ হয়ে পক্ষপাতিত্ব করেননি তিনি বরং জনগণকে ভেবেছেন নিজ পক্ষের একজন। জনগণের প্রতি নিঃস্বার্থ দায়বদ্ধতা তাকে করে তুলেছে অতুলনীয়। বারবার কোমলতার এক সত্যিকারের প্রতীক হিসেবে তিনি হয়েছেন বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। তাই তার অবস্থান হুটহাট কেউ নেবে বা তার মতো হয়ে উঠবেন এমনটা ভাবা তরুণ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিণতি আনতেই পারে। অগোছালোভাবে কিংবা অন্তরে এক, মুখে আরেক নীতিতে কেউ মুজিব হয়ে উঠতে পারবে না এটা মাথায় রাখতে হবে। কেননা মুজিব মানেই সততা, মুজিব মানেই সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে শুভবোধের অঙ্গীকার।
তথাকথিত এসব নামধারী ছাত্রনেতা যে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে বিভ্রান্তির মাধ্যমে সেদিকেও নজর রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। ছাত্র রাজনীতির সোনালি ইতিহাস মুছে যাওয়ার যে পথ পরিক্রমা তৈরি হচ্ছে তা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না কোনোভাবেই। সুস্থ, স্বাভাবিক ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব যে নিতে হবে আমাদেরকেই। মুজিব শতবর্ষে তার প্রতি সম্মানের স্বার্থেই মেধাবীদের ‘আই হেট পলিটিকস’ নীতি বিসর্জন দিয়ে দেশের হাল ধরার সময় কি হয়ে উঠবে না? নাকি সোনার বাংলা হবে আবারো ’৭৫-পরবর্তী সময়ের মতো শ্মশান হিসেবে। পরিস্থিতি এমত হলে সে দায় যেমন তরুণ প্রজন্মের তেমনি মহান নেতার সম্মান রক্ষার দায়িত্বটাও সবার। তার প্রতি যেন না হয় অবহেলা সেটা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। আসুন, আজ থেকেই করি প্রতিজ্ঞা।
সময়ের চলমান গতিধারায় সব চলতে দেওয়া যায় না। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে সময় এখনই। আগাছা কিংবা পথের কাঁটা তুলে না ফেললে যতই আমরা পাঁচ ধাপ আগাই না কেন তা আমাদের দুধাপ স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে দেবে, এটা মাথায় রাখতে হবে। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির সূর্য সন্তানদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেই হোক আমাদের পথচলা।
অনন্য প্রতীক রাউত
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়