ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংগঠনের যৌথ হামলার খবর এখন দেশব্যাপী আলোচনার বিষয়বস্তু। গত ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনে এ হামলার শিকার হন ভিপি নুর এবং তার অনুসারীরা। ঘটনার বিবরণ এরকম— ওইদিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ শেষে ডাকসু ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। সেখানে ভিপি নুরের সঙ্গে তাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কর্মীরা ডাকসু ভবনের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। নুরের অনুসারীরা ভবনের মূল ফটক বন্ধ করে দেয়। একটু পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিৎ চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসাইন মূল ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে ঢুকে পড়ে কিছু ছাত্রলীগ কর্মীও। তারা বহিরাগতদের বের করে দেওয়ার দাবি জানালে তা নিয়ে ভিপি নুরের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একসময় তারা ভিপি নুরের কক্ষ থেকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ কর্মীদের বের করে আনলে সিঁড়িতে অপেক্ষমাণ ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কর্মীরা তাদের প্রহার করতে শুরু করে। এরপর সনজিৎ ও সাদ্দাম মধুর ক্যান্টিনের দিকে চলে গেলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নুরের অফিস কক্ষে ঢুকে বাতি নিভিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। এতে ভিপি নুরসহ ২৪ জন আহত হয়। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের কয়েকজনের চিকিৎসা এখনো চলছে। হামলাকারীরা সেখানে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রও ভাঙচুর করেছে। খুলে নিয়ে গেছে সিসি টিভি ক্যামেরা ও পিসি। ফলে হামলার সময় কারা ছিল তার কোনো ফুটেজ এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এমন একটি বর্বরোচিত হামলার ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও তাদেরই অনুগামী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চই যে এ ন্যক্কারজন ঘটনার হোতা তা নিয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য এর আগেও ভিপি নুর ছাত্রলীগের হাতে একাধিকবার প্রহূত হয়েছেন। কেন ছাত্রলীগ বারবার নুরকে টার্গেট করছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ডাকসু ভবনের ঘটনায় সর্বত্র নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এর হোতাদের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে। অবশ্য হামলায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন ডাকসু এজিএস সাদ্দাম হোসাইন। ঘটনার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা চাই না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটুক। গত কয়েকদিনে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও নুরের সঙ্গে শিবির সংশ্লিষ্টদের ধারাবাহিক সংঘর্ষের ঘটনা দেখেছি। আজকেও মধুর ক্যান্টিন ও ডাকসু ভবনে দুপক্ষ মুখোমুখি অবস্থান করছিল। আমরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি।’ সাদ্দামের বক্তব্যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা দৃশ্যমান হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিতের মন্তব্যে থলের বিড়াল অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। ঘটনার দিন তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন— ‘বহিরাগত শিবির ক্যাডারদের নিয়ে ক্যাম্পাসে হামলা ও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল ‘পাগলা নুরা’। সচেতন শিক্ষার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ স্বাধীনতাবিরোধীদের সমুচিত জবাব দিয়েছে।’ এরপর বোধকরি কাউকে বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের ওই সংগঠনটির শক্তি ও ঔদ্ধত্যের উৎস কোথায়।
ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এ সময় জাহাঙ্গীর কবির নানক উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি। আমরা শুনেছি, তবে ঘটনা এত বর্বর ও পৈশাচিক হয়েছে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো রকম উচ্ছৃঙ্খলতা, শিক্ষার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটানো বরদাশত করবে না এ সরকার। যে মঞ্চের নামেই গোলযোগ করা হোক না কেন, কাউকে বর্তমান সরকার রেহাই দেবে না।’ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে নানক সাহেব সেখানে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কঠোরতা আশা করা যায়। তার আভাসও ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। উক্ত ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন এবং সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্যসহ আটজনের নামোল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরো ৩০/৩৫ জনকে। পুলিশ ইতোমধ্যে আসামি আল মামুন ও ইয়াসির আরাফাতকে গ্রেপ্তার করেছে।
ডাকসু ভবনে হামলার প্রতিবাদে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে বর্বরোচিত ওই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করা হয়েছে। ঘটনাটি সচেতন ও বিবেকবান মানুষদের যারপরনাই ক্ষুব্ধ করেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষকের মন্তব্য থেকে। হামলার পর ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী। পরে নিজের ফেসবুকে তিনি লিখেছেন- ‘চোখের সামনে ডাকসু ভিপি নুর আর অন্যান্য ছাত্রকে মেরে শেষ করে ফেলা হলো; কিছুই করতে পারলাম না। নিজেদের ছাত্রদের রক্ষা করতে পারি না, এই শিক্ষকতার কি দাম আছে? ডাকসু অফিসের দোতলায় উঠে দেখি কেউ পানি পানি বলে চিৎকার করছে। কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওরা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। বারবার আশ্বাস দেওয়ার পরও ভয়ে দরজা খুলছিল না। এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়? আর আমিও একজন শিক্ষক?’ (সমকাল, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)। একজন শিক্ষকের এ খেদোক্তিই বলে দেয় ঘটনাটি কতটা জঘন্য। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘ডাকসু একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। ভিপি নুর শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে কারো মতপার্থক্য থাকলে কিংবা তার কর্মকাণ্ড পছন্দ না হলে তার জবাব পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমেই দেওয়া যায়। এভাবে হামলার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।’ একই পত্রিকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের হামলার ঘটনা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। অভিভাবক, শিক্ষকসহ কোনো সচেতন মানুষই এটা মেনে নিতে পারে না।’ (সমকাল, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)। বস্তুত ঘটনাটি এতটাই ন্যক্কারজনক যে, কারো পক্ষেই তা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- কী অপরাধ ডাকসু ভিপি নুর ও তার অনুসারীদের? ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে, ভিপি নুর শিবিরসহ বহিরাগতদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, অভিযোগ সত্য, তাহলেও কি এ হামলাকে যুক্তিযুক্ত মনে করা যায়? এর জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আছে। তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
ছাত্রলীগ বা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে কি ভিপি নুরকে পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব ইজারা দেওয়া হয়েছে? প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনটিকে নিয়ে। কারা এরা? পেছন থেকে কারা চালাচ্ছে এ সংগঠনটিকে? কাদের মদতে এরা এতটা বেপরোয় হয়ে উঠেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে এর জন্মের ইতিহাস নেড়েচেড়ে দেখা দরকার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের এ সংগঠনটি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপরীতে এর জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিনকে সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের পুত্র আসিবুর রহমান খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয় প্রথম কমিটিতে। পরে আমিনুল ইসলামকে সভাপতি ও আল মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হয় ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় কমিটি। এদিকে সংগঠনটির সভাপতি আ ক ম জামাল উদ্দিন বলেছেন, ‘আমিনুল ইসলাম ও আল মামুন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে গত অক্টোবর মাসে তাদেরকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারা এখন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেউ নন। তারা অন্যায়ভাবে সংগঠনের নাম ব্যবহার করে হামলা সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। এর দায় কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধর মঞ্চের নয়।’ একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রেজিষ্টার্ড সংগঠন নয়। এ মঞ্চের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রোববার এবং তার আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত চলছে। তদন্তের পর এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সে তদন্ত কবে শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কি না তা নিয়ে অনেক্রেই সংশয় রয়েছে। কারণ মুখ রক্ষার এমন বহু তদন্তের নজির কর্তৃপক্ষের রয়েছে। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের নামযুক্ত ওই সংগঠনটির কার্যকলাপ জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে মৃত কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে খবর প্রকাশের পর দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হামলা ও সম্পাদক আবুল আসাদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল এই মঞ্চের কর্মীরাই। প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ সম্বোধন করে দৈনিক সংগ্রাম যে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কেবলই সরকারের। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের তো সে দায়িত্ব কেউ দেয়নি। তাহলে তারা কেন আগ বাড়িয়ে এসব সন্ত্রাসী তৎপরতায় সম্পৃক্ত হচ্ছে? প্রশ্ন উঠেছে— তারা কি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে? নাকি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে ফ্রাংকেস্টাইনের দানব?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিলেন। সম্রাট, খালেদ, জিকে শামীম, আনিসদের গ্রেফতার ও বহিষ্কারের মাধ্যমে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের মেসেজ দিয়েছেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। কিন্তু একজন সম্রাটকে কারান্তরালে পাঠিয়ে যে সমস্যার সমাধান হবে না তা এখন পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের তৎপরতাই বলে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে আরো সম্রাট তৈরি হচ্ছে। এদেরকে এখুনি দমাতে না পারলে পরবর্তীতে সামল দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক