মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শন

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শন

  • এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম
  • প্রকাশিত ৬ এপ্রিল, ২০২১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ, শোষণ-বঞ্চনার শিকল ছেঁড়ার ৯ মাসের যুদ্ধজীবনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল হাজার বছরে গড়ে ওঠা বাঙালির সংস্কৃতিসঞ্জাত এবং একই ভিত্তির ওপর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট দেশপ্রেমমূলক কালজয়ী কিছু গান। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংগীতের ভূমিকা এক অসামান্য ও উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। একটি জাতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তার অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক কালপর্বের প্রভাবও তাকে নানামুখী গতি দেয়। সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি এ তিনের সংমিশ্রণে জাতীয় জীবনের গতিপথ প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বঞ্চনার প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তার সাংস্কৃতিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপটও এই বিশ্লেষণের আওতায় বিবেচিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনের ভিত্তি গ্রোথিত হয়েছিল ১৯৭১-এর বহু আগে। কিন্তু আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর ও বাস্তব সংগ্রাম ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে, ফলে ১৯৭১ শুধুই প্রস্ফুটনের এক উপযুক্ত কাল বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যখন সংগীতের সম্পর্ক আলোচনায় আসে, তখন কেবল ১৯৭১-কে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় ধরলে এর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ হয় না। এ কারণেই দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের গান বলতে আমরা যে গানগুলো চিহ্নিত করছি, তার কোনো কোনোটির রচনাকাল মুক্তিযুদ্ধের বহুকাল আগে।

এ বিষয়টিও বর্তমানে গবেষণার অন্যতম দিক। নানা প্রকার সংগীত, বিশেষত লোকসংগীতের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট আলোচনার পাশাপাশি এসবের মূলভাব দর্শনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত স্বপ্নের স্ফুরণ ছড়িয়েছে মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সংগীত। মানুষ তার মনের আকুতি জানাতে একটু স্বস্তির পরশ নিতে গান শুনতে ভালোবাসে, তেমনি এ গান পরিস্থিতি বিচারে তার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করে। বিশেষ করে ভাটিয়ালির সুর যেমন মাঝিকে মরমি গানের সুর যেমন বাউলকে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন দেশ, মাটি ও বিজয়ের গানে। আমাদের বাঁচামরার লড়াই মুক্তিযুদ্ধে তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল দেশাত্মবোধ জাগানিয়া সংগীতগুলো। এগুলোর টানে মানুষ একাত্ম হয়েছিল, জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল ঐশ্বরিক শুভেচ্ছাদূত বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশ, মা, মাটি ও মানুষের জন্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের স্বাধীনতা। 

স্বাধীনতার এ লড়াই অতটা সহজ ছিল না কিন্তু এর জীবনধর্মিতা খুব সহজেই লড়াইটাকে একান্ত আমাদের করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শনেই নিহিত ছিল যুদ্ধজয়ের অনুপ্রেরণা। এসব সংগীত আমাদের হূদয়ে এমন অনুরণন তৈরি করেছিল যেখানে শত্রুর যুদ্ধের হাতিয়ার তুচ্ছ বলে গণ্য হয়েছিল। তাই শক্তিশালী পাক হানাদার ও তাদের সহায়তাকারী ঘাতক দালালদের ষড়যন্ত্র মুক্তিকামী মানুষের উদ্দীপনার সামনে শক্তিশালী  অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকে এদেশের সংগীত ঐকিক ধারাকে অবলম্বন করে চলছে, যাকে বলা হয় মেলোডিপ্রধান (একরৈখিক)। তাছাড়া মার্গ ও দেশি- এই উভয় পদ্ধতি গ্রামসভ্যতা থেকে উৎসারিত। মার্গসংগীত সুরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, আর দেশি সংগীত কথা ও সুরকে সমান প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলা সংগীত মাত্রই এই দেশি সংগীতের আদর্শে পরিচালিত, লোকসংগীতও এর ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথও লোকসংগীত বলতে দেশি সংগীতই বুঝিয়েছেন। শ্রীশান্তিদেব ঘোষ তার ‘রবীন্দ্রসংগীত’ গ্রন্থে ঋড়ষশ গঁংরপ-এর প্রতিশব্দরূপে ‘দেশি সংগীতকে’ যথোপযু্ক্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আধুনিক সংগীত বিকাশ লাভ করেছে উনিশ শতকে এবং বর্তমানকালে এক বিশিষ্ট আসন করে নিয়েছে। ফলে গ্রাম সভ্যতাজাত সংগীতকে ‘লোকসংগীত’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগের সৃষ্ট সংগীত ও প্রাচীন ধারাশ্রয়ী গ্রামজাত সংগীতের মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন বয়ে আনেনি। আধুনিক সংগীত এবং লোকসংগীত উভয় ধারাই ঐকিক ধারাকে (মেলোডি) অবলম্বন করে বর্তমান অবধি প্রবহমান। সেজন্য ইউরোপীয় সংগীত ধারায় ঋড়ষশ গঁংরপ যেভাবে যুক্তিযুক্ত বাংলা সংগীতে তা প্রযোজ্য নয়। বরং দেশি সংগীতই যথোপযুক্ত। বর্তমান আলোচনায় ‘লোকসংগীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যেহেতু এটিই বিশেষভাবে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়েছে বলে অন্য অর্থে নয়। দেশি সংগীতেরই সমার্থক হিসেবে লোকসংগীতকে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, অনেকে ঋড়ষশ গঁংরপ-এর অনুবাদরূপে লোকগীতি, পল্লিগীতি এবং লোকসংগীত ব্যবহার করেন। লোকসংগীতকে যদিও অনেকটা এর সমার্থকরূপে গ্রহণ করা যায় কিন্তু লোকগীতি বা পল্লিগীতি তা নয়। ঋড়ষশ ঝড়হম-এর অনুবাদ হিসেবে লোকগীতি বলা যায়। আর পল্লিগীতির জন্ম আধুনিক নগরজাত সভ্যতার কোলে। অনেকটা আধুনিক গানের মতো আধুনিক লোকগীতি বা পল্লিগীতি হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা যায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বিভিন্ন গবেষণা হলেও এর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পদক্ষেপ তেমন গভীরভাবে দেখা যায় না বিশেষত সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণী গবেষণা নেহাতই কম। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার চিত্র পরস্ফুিটিত হলেও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি জনমনে যে গভীর ছাপ নিয়ে বিদ্যমান এবং উদ্দীপনা জাগ্রতকরণে সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণ অতি জরুরি। আলোচ্য প্রবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিশেষ দিক হিসেবে সংগীতের প্রভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে; যে দিকটি এতদিন প্রায় উপেক্ষিতই রয়েছে বলা চলে। ক্ষেত্র গবেষণার ফলে প্রবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক উপাদানের বিশেষ করে সংগীতের ভূমিকা বিষয়ক গুরুত্ব অনুধাবন করা সহজ হবে।

বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ একটি জাতি। বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের উন্নত সাহিত্যের গৌরবময় ধারাবাহিকতা। এটি অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নৃতাত্ত্বিকভাবে সমগোত্রীয় একটি জাতি একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় নিজ ঐতিহ্যের ধারা নিয়ে গৌরবের সাথে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে এলেও তার নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বিশেষত ‘জাতিরাষ্ট্র’ গঠনে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর। কিন্তু এ কারণে বাঙালির চেতনা বিদ্যমান ছিল না একথা বলার সুযোগ নেই। জাতি চেতনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও জাতিরাষ্ট্র কেন সৃষ্টি হয়নি সেটি হয়তো ভিন্ন গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমরা এই গবেষণায় দেখব যে, বাঙালির জাতি চেতনা বর্তমান বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে কতটা গভীরভাবে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই ‘জাতি চেতনা’র বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে বাঙালি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার আলোকে যা সে সুদীর্ঘকাল ধরে সযত্নে লালন করে এসেছে। মূলধারার নানান রাজনৈতিক কালপর্বে সামাজিক জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাঙালির জাতিসত্তার বিলোপ কখনোই হয় নাই বরং বহতা নদীর সজীবতা নিয়ে সে বর্তমানে পৌঁছেছে। বাঙালি জাতির এই সজীব সাংস্কৃতিক চেতনাই তার ‘জাতীয়তাবোধ’-এর শক্ত ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, যা উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দুইয়ের সম্মিলনে এক অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার আন্দোলন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়।

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন খুঁজতে যাই, তখন অবিসংবাদিতভাবে একথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন। একইভাবে আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ যুক্তিও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো তার সুদীর্ঘ কালের ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা ও ঐক্য। এ কারণেই আমরা যুক্তি দিতে চাই যে, ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমগোত্রীয় বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে প্রতিকূল পরিবেশ মোবাবিলা করতে হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর রাজনৈতিক উপেক্ষা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা যখন চরমে পৌঁছে, তখনই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও সমভাবে প্রতিভাত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে সম্ভবত জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে বাঙালিকে এমনভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং রাজনৈতিক পরিবেশ যা-ই থাকুক না কেন, বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা তার আপন গতিতেই প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন ইসলামীকরণ নামে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর একটি আঘাত হানে অর্থাৎ পাকিস্তানের ঝঃধঃব উরংপড়ঁৎংব যখন বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি একটি অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখনই বোঝা যায় বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণভ্রমরা আসলে তার সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য- যার ওপর আঘাত  বাঙালি জাতি সহ্য করতে পারেনি আর এ কারণেই রাতারাতি দ্বিজাতি তত্ত্বের দর্শন ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়।

লেখক : পুলিশ  সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads