মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গৌরব ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা, এই শব্দটির সঙ্গে মানুষ তার নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষমাত্রেই আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার। সীমাহীন নীলিমায় ওড়ার। আর এই স্বাধীনতা যদি হয় রক্তের বিনিময়ে, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে তাহলে তার স্বাদটাও পাল্টে যায়। তখন এই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে আরও বেশি অর্থবহ। অনেক বেশি আনন্দের উপলক্ষ। পলাশীর প্রান্তরের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অনেক সংগ্রাম, লক্ষ মানুষের রক্ত, নানা বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস পেছনে ফেলে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখা পাই স্বাধীনতার। এর মাঝে আমাদেরকে পার করতে হয় দুটি দেশের শাসন এবং শোষণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানি শাসনের ভূত। তাদের তাড়াতে, কাঁধ থেকে নামাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ২৩টি বছর। এর মাঝের ইতিহাস শুধুই অপ্রাপ্তি, হতাশা আর শোষণের। এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ শুরু হয় ১৯৭১-এ। মুক্তিপাগল বাঙালি পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষ প্রাণ আর হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। আমাদের সব মানুষের প্রিয় শব্দ এটি।
একটি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে থাকে দেশের শিল্প ও সাহিত্য। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও জড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মর্যাদার সঙ্গেই শিল্প-সাহিত্যে তুলে ধরায় অংশ নিয়েছেন আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা। বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের রচনার মাধ্যমে। সাহিত্য ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। সময়ের ধারাবাহিকতায় সাহিত্যে বিভিন্ন উপাদান, অনুষঙ্গ জারিত হয়ে উপস্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পরবর্তী অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকেই আমাদের সাহিত্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে। এ পটভূমিকায় ১৯৭১-এ সদ্য স্বাধীন দেশের সাহিত্যে প্রভাব ফেলতে থাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সাহিত্যের উৎকর্ষে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে মুক্তিযুদ্ধ। তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে নানা ধরনের সাহিত্যসৃষ্টির প্রবণতা। আর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে অব্যাহত থাকবে বলেও আশা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামশীলতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, বীর্যবত্তা ইত্যাদি গুণের পরিচয় বিধৃত হয়ে সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ক্রমেই স্বমহিমায় অবয়ব লাভ করেছে। তাই বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
যে কোনো জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের পেছনে থাকে আবেগ-উচ্ছ্বাস। সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম নয়। আবেগ-উচ্ছ্বাস কমে এলেই তখন মহৎ রচনা সম্ভব হয়। আমাদের সাহিত্যে কবিতা, নাটক, উপন্যাস সবখানেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখ করার মতো অনেক কাজ হয়েছে। বিশেষত কবিতায় এ ধারার প্রকাশ লক্ষ করার মতো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আমাদের গৌরবময় এই অধ্যায় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বিশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তর দশকের কবি-সাহিত্যিকরা। পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের অনেক কবি-সাহিত্যিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাদের কলমে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দশক, আমাদের সত্তর দশকের কবি-সাহিত্যিকরাও তাদের লেখায় তুলে এনেছেন বিজয়ের গৌরবগাথা। আবার একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের দ্বিধা-পরাজিত শক্তির ফিরে আসা-জাতির পতাকায় তাদের হিংস্র ছোবল— কোনো কিছুই এই দশকের কবি-সাহিত্যিকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তারা নানাভাবে আমাদের সাহিত্যে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। তবে এই ধারা থিতিয়ে আসে আশির দশক থেকেই। এরপরের আরও দুটি দশক— নব্বই এবং শূন্য। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বড়মাপের কাজ তো দূরের কথা, আমাদের সাহিত্যে এ সময়ের লেখকদের লেখায়, চিন্তায়-চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এর কারণ হয়তোবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের— আমাদের জাতীয় জীবনের সবেচেয়ে গৌরবের বিষয়টিকে কালিমালিপ্ত করে ফেলা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করে তোলা হয়েছে বিতর্কিত। ব্যক্তিস্বার্থে এবং পরাজিত শক্তির অপপ্রচারের জোয়ারে একদা কোণঠাসা হয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি স্বাধীনতার বার্তা। আর পক্ষ-বিপক্ষের মাঝে পড়ে নতুন প্রজন্ম, এই গ্লোবালাইজেশনের সময়ে এক ছাতার নিচে পৌঁছার ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের যোগ্য করে তোলার লড়াইয়ে ভুলে ছিল জাতির ইতিহাস, পেছনের গৌরবগাথা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যা রচিত হয়েছে তাতে মহৎ কোনো রচনার দেখা হয়তো আমরা পাইনি। পাইনি কোনো বড় ক্যানভাসের সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্যকর্ম। গড়ে ওঠেনি কোনো মহৎ উপন্যাস, যা হয়েছে তাতেও অনেক সময় সত্যিকার ইতিহাসের চেয়ে কোনো দলের মতবাদ প্রচারের দিকেই নজর দিয়েছেন অনেক ঔপন্যাসিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলনও এসব অনেক রচনাতেই নেই, যা আছে তা খণ্ডিত, অনেকক্ষেত্রে বিকৃত, একদেশদর্শী।
মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের অনেক কাছের একটি বিষয়। অনেকক্ষেত্রেই এখনো আবেগের স্থিতি কমেনি। তাই সাহিত্যিকরাও এর বাইরে আসতে পারছেন না। হয়তো আরো, আরো কয়েক দশক পর— যখন থিতিয়ে আসবে সব আবেগ, তখন হয়তো সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসবে, গবেষণায় উঠে আসবে সকল মিথ্যা এবং ভ্রান্তির জাল। তখন হয়তো আমাদেরই নতুন কোনো সাহিত্যিক রচনা করবেন মহৎ সাহিত্যকর্ম। যেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের গৌরবের, আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার প্রতিফলন হবে।