স্বাধীনতা শব্দটি মুক্ত পাখির মতো মনে বিহ্বলতা সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা বলতে মনে পড়ে যায় সারি সারি ধানক্ষেতের মাঠ, যেখানে প্রকৃতি যেন সীমাহীন আনন্দে গায়ে সবুজ রং মাখে, আর সেই সবুজ মাঠের মেঠোপথে কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান ধরে মুখে অম্লান হাসি নিয়ে লাঙ্গল কাঁধে যেন হেঁটে যাচ্ছে এক কৃষক। মনে পড়ে সেই কৃষকের পল্লীগ্রাম যেখানে মোগল শাসন নেই, ব্রিটিশ শাসন নেই, নেই পাকিস্তানিদের শোষণ, আছে রক্তের দামে কেনা গণতন্ত্র। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে বাংলার বিপ্লবী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, যার ফলে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে হাঁটছে। এই পথকে আরো মসৃণ করে তুলতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করতে হবে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে হাঁটলেও কিছু সামাজিক, জাতীয় ও অবকাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের উন্নয়নকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অগ্নিঝরা ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না।’ সেই মহান নেতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে ভীষণ ইচ্ছে হয়- ‘হে দুঃখ-দুর্দশা, ক্লেশ, তোমরা সতেরো কোটি (প্রায়) জনগণকে কাবু করতে পারবা না। উন্নয়নের যে পথে আমরা হাঁটতে শুরু করেছি, সে পথ একদিন শেষ হবেই হবে, ইনশাআল্লাহ।’ এর জন্য শুধু প্রয়োজন বাংলার প্রতিটি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বোঝায়, যেসব কারণে বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল দেশকে স্বাধীন করার ব্রত। বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সর্বস্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করা। মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ অনেক সুন্দরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, সবাইকে ভালোবাসা, সবাইকে ভালো রাখা, আদর্শিক জায়গায় সৎ থাকা এবং অপশক্তির বিরুদ্ধে সবাই মিলে রুখে দাঁড়ানোই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা বুকে লালন করে আমরা জয়লাভ করেছিলাম, সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সমাজ থেকে দূর করতে হবে দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ ও সব ধরনের বৈষম্য। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতি ধারণা সূচক ২০২০’-এর তথ্য অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৯ সালে নিম্নক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। এছাড়াও গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সে ঝুঁকির দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছিল ২১তম, ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৫তম এবং ২০১৯ সালে ৩১তম হয়। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গর্বিত কিছু নেতা। যার আঙুলের একটা ইশারায় বাংলার সমস্ত মানুষের মাঝে স্বাধীনতার নেশা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তার মতো করেই এখনকার নেতাকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে হবে। কারণ একজন নেতার নেতৃত্বের গুণাবলি যত প্রখর হয়, সেই দেশও তত এগিয়ে যায়।
একটি জাতি, যার তেমন সজ্জিত যুদ্ধাস্ত্র ছিল না, প্রশিক্ষিত বাহিনী ছিল না; অপরপক্ষে বিপক্ষদল ছিল খুবই শক্তিশালী- যাদের শক্তিশালী পরিকল্পনা ছিল, সুসজ্জিত বাহিনী ছিল, কিন্তু তারপরও হেরে গিয়েছিল বাঙালি জাতির কাছে। কারণ বাঙালি জাতির সজ্জিত অস্ত্র, সুসংগঠিত বাহিনী ও শুরুতে বিশেষ পরিকল্পনা না থাকলেও ছিল দারুণ মনোবল, রক্তে ছিল তেজ। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের সে রকমই মনোবল প্রয়োজন। ছোট্ট সীমানায় ঘেরা, সৌন্দর্যের মহিমায় মহিমান্বিত এই বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো এদেশের অধিক জনসংখ্যা। বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা মোট ১৬ কোটি ৪৭ লাখ এবং বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। আয়তনের তুলনায় বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে নিতে হবে যুগোপযোগী পদক্ষেপ। ইতিহাস সাক্ষী, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে তাদের যোগ্য করে তোলা হয়েছিল এবং মুজিবনগর সরকারের সঠিক নির্দেশনায় তারাই ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ইতিহাসের এই বিজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে যে গুরুদায়িত্ব আমাদের কাঁধে বহমান, সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলে কাজে লাগাতে হবে দেশের উন্নয়নে।
যে চেতনা একটি দেশকে শোষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেই চেতনা বুকে লালন করলেই উন্নয়নের পথে আসা বড় বড় বাধা ও সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হয়ে উঠুক আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করতে হবে তাদের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই ও নির্মিত বিভিন্ন ছবি, নাটক বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। ৩-৫ বছর বয়সে শিশুরা যে কোনো বিষয় খুব সহজে শিখতে পারে। এই বয়সে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে হাতে স্মার্ট ফোন না দিয়ে তাদেরকে অনুপ্রেরণামূলক মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুর মা ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথ, সময়োপযোগী ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের গণমুখী প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো কী হবে, সেই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে পরিকল্পনা কমিশন একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। যুদ্ধের পর বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল, তখন এ দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। বঙ্গবন্ধু তার সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে খুব দ্রুত সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত এই বাংলাদেশের উত্তরোত্তর অগ্রগতির জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রতিটি সংকট ও সমস্যা আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সঠিক সমাধানের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সেখানে নিয়োগ দিতে হবে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিককে।
লেখক : সুমনা আক্তার
শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়