মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে বক্তৃতা করেন

ছবি : পিআইডি

সরকার

মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ

জাতিসংঘে ভাষণে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় জিরো টলারেন্সের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের করা চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার বিকালে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও নারীর ক্ষমতায়নে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে তাই এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে। জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে আমরা তার দ্রুত বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। সাধ্যমতো তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি সই হয়েছে। তবে মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে আমরা হতভম্ব। একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে। একই দিন নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ওআইসি কন্টাক্ট গ্রুপের সভায় এই সঙ্কট মোকাবেলায় মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা তুলে ধরে জাতিসংঘ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১০ শান্তিরক্ষী পাঠানোর মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ শান্তিরক্ষী জীবনদান করেছেন। বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ নারীসহ বাংলাদেশের মোট ৭ হাজারেরও বেশি শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীরা তাদের পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।

নিরাপদ, নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন বিষয়ক ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট’-এর মূল প্রবক্তা হিসেবে বাংলাদেশ আরো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও মানবাধিকার কেন্দ্রিক একটি কম্প্যাক্ট প্রত্যাশা করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অভিবাসনবিষয়ক এই কম্প্যাক্ট অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় একটি ক্রমঃপরিবর্ধনশীল দলিল হিসেবে কাজ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সব সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা পরিচালিত হতে দেব না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে গৃহীত ‘গ্লোবাল কল টু অ্যাকশন অন দ্য ড্রাগ প্রবলেম’-এর সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে বলেও তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের বিবেচনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বৈশ্বিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা শুরু করেছে। দেশে ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কর রেয়াত, দ্বৈতকর পরিহার, শুল্ক ছাড়সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের যৌথ উদ্যোগে ১১টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হিসেবে তিনি বৈশ্বিক নেতাদের কাছে পানির যথাযথ মূল্যায়ন, ব্যবস্থাপনা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশন এবং ৮৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা বিভিন্ন সামাজিক সূচকে প্রভূত অগ্রগতি অর্জন করেছি। শিক্ষার হার গত সাড়ে ৯ বছরে ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

নারী উন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক হলো ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন আমরা নিশ্চিত করেছি। এদিন নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতি ত্বরান্বিত করা নিয়ে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় তিনি বলেন, নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি, সহিংসতাসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নারীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জীবন ও জীবিকার সব ক্ষেত্রে নারীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে- এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, সেবা ও শিল্প খাতে প্রায় ২ কোটি নারী কর্মরত রয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের জামানত ছাড়াই ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সংসদই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সংসদ যেখানে সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার এবং বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বর্তমান সংসদে ৭২ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে আমরা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের এক শতাংশ ব্যয় করছি এবং জলবায়ু সহায়ক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ একটি জলকেন্দ্রিক, বহুমুখী এবং টেকনো-ইকোনমিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা দীর্ঘ ৮২ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাসস।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads