আগামী মার্চেই শেষ হচ্ছে কারাবন্দিদের নিয়ে তৈরি ডাটাবেজের কাজ। এক্ষেত্রে হাজতি ও কয়েদি সবারই তথ্য থাকছে এই ডাটাবেজে। দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। নিয়মিত বন্দির সংখ্যা ৮০ থেকে ৯০ হাজারের মধ্যে উঠানামা করে। ক্লিকের ব্যবধানেই জানা যাবে কোন বন্দি কোন কারাগারে আছে, তার অপরাধের ধরন, কী কারণে কারাগারে যেতে হলো, মামলার সংখ্যা, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, আদালতে হাজিরার তারিখসহ যাবতীয় তথ্য। ওই বন্দি কত দিন ও কত বার জেল খেটেছে, থাকবে সেই তথ্যও। ডাটাবেজ তৈরির পর জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে ডাটাবেজটি। এতে জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথও বন্ধ হবে।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) তত্ত্বাবধানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব এই ডাটাবেজের কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১১ সালে এই ডাটাবেজের কার্যক্রম শুরুর সাথে র্যাবের প্রশিক্ষিত অপারেটররা দেশের ৬৩ জেলার কারাগারে ফৌজদারি দন্ডপ্রাপ্তদের ডাটা এন্ট্রি করে। ডাটা এন্ট্রির কার্যক্রমে প্রথমে অপরাধীর ছবি নেওয়া হয়। অপরাধীর আঙুলের ফিংগার প্রিন্ট ও চোখের মনি স্ক্যান নেওয়া হয়। এছাড়া এ পর্যন্ত র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে যে সব অপরাধীরা আটক হয়েছে, তাদের তথ্য ডাটাবেজে প্রতিদিনই সংগ্রহ করা হচ্ছে। এভাবে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন অপটিক্যাল ফাইবার লাইনের মাধ্যমে র্যাব সদর দপ্তরের সাথে যুক্ত প্রতি ব্যাটালিয়ন এবং তাদের অধীন সব ক্যাম্প।
কর্মকর্তারা জানান, ডাটা এন্ট্রি প্রতিদিন সরাসরি র্যাব সদর দপ্তরে রক্ষিত সার্ভারে সংরক্ষিত করা হয়। এর জন্য প্রতিটি ব্যাটালিয়ন এবং তাদের কোম্পানিতে ওয়ার্ক স্টেশনে এবং প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। র্যাব তাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অপারেটরদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। র্যাবের ক্রিমিনাল ডাটাবেজ, বাংলাদেশে এ যাবৎকালের সর্ব বৃহৎ ক্রিমিনাল ডাটাবেজ।
কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি নির্মূলে র্যাবের সাফল্যের নেপথ্যে অন্যতম বড় ভূমিকা রেখেছে এই তথ্যভান্ডার। জেএমবি, হুজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্তদের তথ্য র্যাবের কাছে থাকায় সহজেই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে। র্যাবের ধারাবাহিক তৎপরতার কারণে জঙ্গি তৎপরতা এখন অনেকটাই স্থিমিত হয়ে এসেছে। প্রত্যেক অপরাধীর নামে একটি কোড নম্বর খোলা হয়েছে। ওই কোড নম্বর চাপলেই বেরিয়ে আসবে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর সংরক্ষিত সব তথ্য। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ অপরাধীদের ব্যাপারে সেখানে আগে থেকেই কাজ করছে। জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ব্যাপারে সেখানে তথ্য থাকে। বাংলাদেশ সে পথে এগোতে চায়। এ ছাড়া জঙ্গিদের ব্যাপারে ডাটাবেজে সব ধরনের তথ্য থাকছে। জঙ্গিদের পরস্পরের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক ছিল-এ ধরনের বিবরণও যুক্ত করা হয়েছে। কোনো অপরাধী সম্পর্কে সর্বশেষ কোনো তথ্য পাওয়া গেলে, তা ডাটাবেজে যুক্ত হবে। এছাড়াও সমপ্রতি এমআরপি এর সাথে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি চলমান আছে। ভবিষ্যতে বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স, ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যা ডিজিটাল বা ইন্টারনেট বেইজ ক্রিমিনাল অপতৎপরতাকে প্রতিহত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, কোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তারের পর তার পরিচয় শনাক্ত ও অতীত অপরাধ রেকর্ড (পিসিআর) জানতেই অনেকটা সময় চলে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধীরা নিজেদের আড়াল করতে মিথ্যা তথ্যও দিয়ে থাকে। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে বিলম্বের এটি অন্যতম একটি কারণ। আবার দন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুনরায় অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। বেশিরভাগ সময়ে তারা স্থান পরিবর্তন করায় তাদেরকে চিহ্নিত করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। র্যাব কর্তৃক প্রনয়ণকৃত এ নতুন ব্যবস্থার ফলে তথ্য ভান্ডারের সহায়তায় যে কোনো দুস্কৃতকারীকে সহজেই আইনের আওতায় আনা যাবে। এছাড়া অপরাধীর পক্ষে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তদন্ত কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করাও সম্ভব হবে না। সম্পূর্ণ ডিজিটাল ফরম্যাটে প্রস্তুত এই তথ্যভান্ডার থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে মুহূর্তে একজন অপরাধীর বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে এই তথ্যভান্ডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ প্রযুক্তির ফলে একই ব্যক্তির বারবার অপরাধ ঘটানোর প্রবণতাও কমে আসবে। কারণ সে জানবে অপরাধ করে তার পক্ষে পালিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে এই তথ্যভান্ডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। র্যাবের এ তথ্যভান্ডারে প্রত্যেক অপরাধী সম্পর্কে ১৫০ ধরনের তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীর আঙুলের ছাপ ও চোখের চিত্র নেওয়া হয়। এছাড়া অপরাধীর ডিএন-সংক্রান্ত তথ্যও রাখা যাবে এ তথ্যভান্ডারে। এর বাইরে ছবি, অতীত অপরাধ সংঘটনের সংখ্যা, অপরাধের ধরন, দন্ডসংক্রান্ত তথ্যও সন্নিবেশ করা হয়েছে। এসব তথ্যের সঙ্গে অপরাধীর নাম, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি ব্যক্তিগত বিস্তারিত তথ্য রাখা হয়েছে। র্যাবের সম্পূর্ণ নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে এ তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে পুলিশও ডাটাবেজ সংগ্রহের কাজ শুরু করে। থানায় আটক হওয়া প্রত্যেক অপরাধীর ডাটাবেজ সংগ্রহ করা হয়। র্যাব পুলিশের পাশাপাশি কারাগারও ডাটাবেজ করার কাজ শুরু করে। এনটিএমসির সহযোগিতায় র্যাব এ ডাটাবেজ তৈরি করছে।
কারা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সালের জুন থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এবং গাজীপুর জেলা কারাগারে পাইলটভিত্তিতে কারাবন্দিদের ডাটাবেজের কাজ শুরু হয়। ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) আর্থিক সহযোগিতায় বায়োমেট্রিক তথ্য সম্বলিত এ ডাটাবেজের কাজ শুরু হয়। ওই বছরের (২০১৯) ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এবং গাজীপুর জেলা কারাগারে পাইলট প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার এবং জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পোও উপস্থিত ছিলেন।
এর কিছুদিন পর ডাটাবেজ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। যার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এনটিএমসি। অবশ্য র্যাব ২০১৬ সালেই নিজস্ব উদ্যোগে অপরাধীদের ডাটাবেজ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ‘র্যাব-প্রিজন ইনমেট ডাটাবেজ’ নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল। তখন এটা নিয়ে র্যাব অনেক দূর এগোলেও পরে নানা জটিলতায় স্তিমিত হয়ে পড়েছিল ডাটাবেজটি।
কারাবন্দিদের নিয়ে চলমান ডাটাবেজ প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) কর্নেল মোঃ আবরার হোসেন বলেন, এটি তৈরির দায়িত্ব এখন পালন করছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। তারা এটা র্যাবের মাধ্যমে করবে। মাঝে খানিকটা থেমে ছিল। পরে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইউএনওডিসি আমাদের সঙ্গে চুক্তিতে আসে। ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৪৫টি কারাগারে কারা কাজ শেষ করেছে। বাকিগুলোর কাজও দ্রুত শেষ হবে।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিএমসি পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান বলেন, ডাটাবেজের কাজ চলছে দ্রুত। আশা করছি তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে।
তিনি আরো বলেন, মানুষ জেলে গেলেই অপরাধী হয়ে যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারের মাধ্যমে কেউ অপরাধী হিসেবে স্বীকৃত না হবে, ততক্ষণ কিন্তু সে অপরাধী নয়। তাই এ ডাটাবেজে নাম থাকা মানেই ওই ব্যক্তি অপরাধী নয়। অনেক দেশেই প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেসব মানুষকে আটক বা গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়, তাদের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ দেশের অন্যান্য যত ডাটাবেজ আছে, সবগুলোর সঙ্গেই আমাদের সংযোগ আছে। সেগুলোর সঙ্গে এই ডাটাবেজেরও সংযোগ থাকবে।
ডাটাবেজের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে কারাবন্দি মানেই কিন্তু অপরাধী নয়। আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যায় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের ডাটাবেজ আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একবার যাকে গ্রেপ্তার বা আটক করবে, তার তথ্য ডাটাবেজে চলে যাবে।
ডাটাবেজে বন্দির ছবি, বায়োমেট্রিক ছাপ, চোখের মনির স্ক্যান ও আগের অপরাধের রেকর্ডসহ সব তথ্য রাখা হবে। এতে বন্দির নিরাপদ আটকের বিষয়েও স্বচ্ছতা আসবে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা কারাগারে গেছে, তাদের নজরদারিতে রাখাও সহজ হবে। এ ছাড়া, কোন কারাগার থেকে কতজন বন্দিকে আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সঠিকভাবে তাদের কারাগারে ফেরত নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে কিনা, তাও জানা যাবে। প্রত্যেক কারাবন্দির আলাদা প্রোফাইল তৈরি হবে এতে। এতে কোন বন্দির জন্য কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন, সেটাও সহজে জানানো যাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।