দ্রব্যমূল্যের বাজারে হঠাৎ করে শুরু হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। যে পেঁয়াজ বিক্রি হতো ৪০/৫০ টাকা কেজিতে তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ টাকা। চালের দাম ক্রমেই বাড়ছে এবং তা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলেছে। সবজির দাম এখন গড়ে তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে, মাছের বাজারেও পড়েছে মূল্যবৃদ্ধির কালো ছায়া।
নিত্যপণ্যের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল-ডাল-শাকসবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে। সরকার সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখতে এবং কেউ যাতে অতি মুনাফার আশ্রয় না নেয়, সে বিষয়ে নজর দিতে পারে। পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধ করেও নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখা যেতে পারে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা জনগণের কাছে সরকারের সুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দুটি বিষয় প্রত্যাশা করে, তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের সবকিছু করবে, জনগণ তা দেখতে চায়। কিন্তু দেশ পরিচালনায় সরকারের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে দেশে ভয়াবহ পেঁয়াজ সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারদলীয় সিন্ডিকেটের কারণ শুধু পেঁয়াজ নয়, সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন চালাতে গিয়ে বর্তমানে দেশের সৎ ও সচ্ছল মানুষেরও জীবনে ত্রাহি অবস্থা। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তার স্বল্প আয়ের কারণে যেমন সীমিত থাকে, ঠিক তেমনি জিনিসপত্রের বাজার দর দ্বারাও তা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিত্তবানদের জন্য দ্রব্যমূল্য প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তেমন একটা সমস্যা নয়। কারণ তার আয় সব সময় সীমাহীন। জিনিসপত্রের দাম যতোই বাড়ুক, সবই তার নাগালের মধ্যে; কিন্তু সাধারণ মানুষ যে আয় করে তা দিয়ে তাকে হিসাব করে জিনিসপত্র কিনতে হয়। মানুষের আয় যতটা বাড়ে, সেই তুলনায় যদি জিনিসপত্রের দাম অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি বৃদ্ধি পায়, তাহলেই তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাই হলো তার ‘প্রকৃত আয়’। ‘প্রকৃত আয়’ বৃদ্ধি না পেয়ে যদি একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে তা হলেই শুরু হয় আশাভঙ্গের যন্ত্রণা। আর যদি ‘প্রকৃত আয়’ কমে যায় তাহলে যে মরণ যন্ত্রণা— তার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আয়ের পরিমাণ ও বাজারদর— এই দুইয়ের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করাটাই হলো দ্রব্যমূল্য সমস্যা সমাধানের আসল উপায়। বাজার দর বৃদ্ধির তুলনায় আয় বাড়লো কিনা, কিংবা উল্টো করে বললে, আয় বৃদ্ধির তুলনায় বাজার দর কম বাড়ল কি না, সেটিই দেখার বিষয়। চাল-ডাল-তেল-চিনির দাম যদি পাঁচগুণ বাড়ে তাতে মানুষের কোনো যন্ত্রণাই তেমন থাকবে না, যদি তাদের সকলের আয়ও পাঁচগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।
দ্রব্যমূল্যের সমস্যার উৎস দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী ইত্যাদি। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না, কৃষক তার ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পায় না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা ‘প্রকৃত আয়’ বৃদ্ধি না পেয়ে কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা। ‘প্রকৃত আয়’ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চলে যায় অনেকগুলো মাস-বছর। ততদিনে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তার ‘প্রকৃত আয়’কে আবার পেছনে ফেলে দেয়। দ্রব্যমূল্যের যন্ত্রণা চলতে থাকে নিরন্তর। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য মানুষের ‘প্রকৃত আয়ের’ ধারাবাহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য একসঙ্গে দুদিক থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত ব্যাপক জনগণের ধারাবাহিক আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। দ্বিতীয়ত মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন তা স্থিতিশীল থাকে কিংবা বৃদ্ধি পেলেও তা যেন কখনোই কোনোভাবে আয় বৃদ্ধির সাধারণ হারের ঊর্ধ্বে না ওঠে।
আয় বাড়ানো ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ— এই উভয় দিক থেকে গ্রহণ করা এসব ব্যবস্থার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের ‘প্রকৃত আয়’ ও ক্রয়ক্ষমতা স্থিতিশীল রাখা এবং তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারকে। একই সঙ্গে জনগণ ও সমাজকে এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আমাদের সাধারণ মানুষের আয় মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সব চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে অবশ্যই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিহত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই মানুষ এই অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে।
ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক





