মানুষের জীবন কি ‘ডাল-ভাত’

ছবি: বাংলাদেশের খবর

মুক্তমত

অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন

মানুষের জীবন কি ‘ডাল-ভাত’

  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল, ২০২১

ইসমাইল মাহমুদ

বছরের পর বছর ধরে আগুন আতঙ্কে দিন যায়, রাত কাটে পুরান ঢাকাবাসীদের। উদ্বেগ আর আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, নিমতলী, আরমানিটোলাসহ আশপাশের এলাকার সাধারণ মানুষের। আর এই আতঙ্কের মূল কারণ আবাসিক এ এলাকায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের ব্যাপক মজুত। কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ নামক ‘বোমা’র সাথেই বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছেন পুরান ঢাকার অধিবাসীরা। একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনার পরও সরানো বা বন্ধ করা হচ্ছে না অবৈধ এসব কারখানা। ২০১০ সালে নিমতলা ও ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর সর্বশেষ শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোররাতে আরমানিটোলায় কেমিক্যাল গোডাইনে সংঘটিত হয় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ জন আর আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন ২১ জন মানুষ।

একের পর এক এসব ঘটনায় অকাতরে ঝরেছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। পুড়ে ছাই হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। অথচ কেমিক্যাল গোডাউন ও দাহ্য পদার্থের গোডাউনে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কর্তৃপক্ষের চরম নিষ্ক্রিয়তায় এসব অগ্নিদুর্ঘটনায় একদিকে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা, অন্যদিকে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। একের পর এক আগুনের ঘটনা যখন ঘটে তখন সরকারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও দাহ্য পদার্থের ব্যবসা সরানোর আশ্বাস দিলেও আশ্বাসের বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে না। বন্ধ হচ্ছে না মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা। হরহামেশাই কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের ব্যবসায়ীদের লোভের আগুনে পুড়ে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হচ্ছে পুরান ঢাকার অলি-গলি। যার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটল শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোররাতে আরমানিটোলার আরমানিয়ান স্ট্রিটে ৯/১১ নম্বর ছয়তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন হাজী মুসা ম্যানসনে। এখানে একটি কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছেন ২১ জন আর প্রাণ হারিয়েছে ৪ তাজা প্রাণ। নিহতরা হলেন হাজী মুসা ম্যানসনের বাসিন্দা ইডেন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া সরকার, ভবনের দোকান কর্মচারী মো. রাসেল মিয়া, নিরাপত্তা কর্মী অলিউল্লাহ ও তার আত্মীয় মো. কবির হোসেন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন ৩ ফায়ারকর্মীসহ আরো ২১ জন।

নিমতলি ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয় ২০১০ সালের ৩ জুন রাত ১০টা ৩০ মিনিটে। পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলী মহল্লায় একটি কেমিক্যাল গোডাউনে স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে মহিলা ও শিশুসহ প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ আর আহত হন শতাধিক। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সরকার এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতের স্মরণে ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। এর ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ওই এলাকার ওয়াহেদ ম্যানশনে গড়ে তোলা কেমিক্যালের গোডাউন থেকে সৃষ্ট ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু ঘটে ৭৮ জনের। আহত ও দগ্ধের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শতাধিক।

নিমতলী এবং চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পাদার্থ, রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দুটি ঘটনার পরই প্রাথমিকভাবে কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হতে দেখা যায় প্রশাসনকে। এর পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও ঢাকঢোল পিটিয়ে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর অভিযান শুরু করে। কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ করতে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। সে সময়ে টাস্কফোর্সের অভিযানে সিলগালা করা হয় ১৭০টি গোডাউন। বিভিন্ন ভবন থেকে জব্দ করা হয় কেমিক্যাল; জরিমানা করা হয় অনেক ভবন মালিককে। এসব গোডাউনের বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর ‘যেই লাউ সেই কদু’। মাত্র ২ মাস অভিযান চালানোর পর ওই বছরের ১ এপ্রিল অজ্ঞাত কারণে পুরোপুরি থমকে দাঁড়ায় অভিযান। কিছুদিনের মধ্যেই সিলগালা করে দেওয়া গোডাউন ও প্রতিষ্ঠান ফের চালু হয়। এ ছাড়া পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন স্থানান্তরের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সে প্রক্রিয়া এখনো অনেকটা থেমে আছে। ফলে পুরান ঢাকা এখন অনেকটা কেমিক্যাল নগরীতে পরিণত হয়েছে।

নানা প্রতিষ্ঠানের জরিপ ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ২০০ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রায় ৩ হাজার অবৈধ গোডাউন রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায়। ২০১০ সালের জুন মাসে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু ১১ বছরেও এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানান্তর হয়নি পুরান ঢাকার অবৈধ রাসায়নিক গুদাম-কারখানা-দোকান।

আমাদের দেশের স্থায়ী একটি সংস্কৃতি হলো বড় কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ হলেই তৎপর হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সে সময়ে কর্তৃপক্ষের দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়। ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি বা কমিশন গঠন হয়। তদন্ত কমিটি বা কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে একের পর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই ফের পুরোপুরি থমকে দাঁড়ায় সবকিছু। স্থায়ীভাবে ঝুলে যায় সমস্যা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সেখানে পুরান ঢাকার সকল কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তর করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও এ প্রকল্পের কাজ চলছে পুরোপুরি ঢিমেতালে। গত ২ বছরে এ প্রকল্পের সিকিভাগ কাজও হয়নি। প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে তা কারো জানা নেই। এ ছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সেখানে পুরান ঢাকায় প্রায় ৩ হাজার কেমিক্যাল গুদাম-কারখানার মধ্যে মাত্র ৬০০টি কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা স্থানান্তর করা যাবে। এ ছাড়া গাজীপুরের টঙ্গী এবং রাজধানীর শ্যামপুরে যে কেমিক্যাল পল্লীর কাজ চলছে সেটি প্রস্তুত হলে মাত্র ১০৭টি কেমিক্যাল গুদাম-কারখানা স্থানান্তর করা হবে। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় মুন্সীগঞ্জের ‘কেমিক্যাল পল্লী’ এবং গাজীপুরের টঙ্গী এবং রাজধানীর শ্যামপুরে ‘কেমিক্যাল পল্লী’ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে চালু হওয়ার পরও স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না অর্থাৎ ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা কেমিক্যালের অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে। এ থেকে উত্তরণে এবং পুরান ঢাকাকে নিরাপদ রাখতে প্রধানমন্ত্রীর কেমিক্যাল গোডাউন-কারখানা স্থানান্তরের নির্দেশাবলি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। আরো কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরান ঢাকায় যারা এসব ব্যবসা অবৈধভাবে পরিচালনা করছেন এবং যারা ভাড়া দিচ্ছেন তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। একের পর এক কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই মানুষের জীবনকে ‘ডাল-ভাত’ বানিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ ব্যবসা। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নতুবা প্রতিনিয়তই পুরান ঢাকার অলি-গলিতে গড়ে ওঠা অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

 

লেখক ও কলামিস্ট

ভবধঃঁৎব.রংসধরষ২০২১—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads