সম্পাদকীয়

মানিলন্ডারিং আইন : সমকালীন প্রসঙ্গ

  • প্রকাশিত ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০

আবুজার গিফারী

 

যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যত স্বচ্ছ ও নিখুঁত, সে দেশ ততই উন্নত। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হলো মানিলন্ডারিং তথা অর্থপাচার। বর্তমানে দেশে অর্থপাচারের খবর নিত্যঘটনা। পত্রিকা থেকে শুরু করে সকল মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হলো অর্থপাচারের খবর। সাময়িক স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের দেশের অর্থ অন্য দেশে পাচারের ফলে উন্নত দেশ আরো উন্নত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে। অর্থপাচারের এই প্রবণতা এক-দুই বছরে তৈরি হয়নি বরং সত্তরের দশক থেকেই চলে আসছে। মূলত তখন থেকেই দেশের বড় বড় আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা অর্থপাচারের এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মানিলন্ডারিং বলতে বোঝায়, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে সেই সম্পদের আংশিক বা পূর্ণ অংশ রূপান্তর বা এমন কোনো বৈধ জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়, যাতে সেই বিনিয়োগ করা সম্পদ থেকে অর্জিত আয় বৈধ বলে মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের সক্রিয় সহায়তায় মানিলন্ডারিং কার্যক্রম চলে। মানিলন্ডারিং একটি ফৌজদারি অপরাধ। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালে আরো পাচার হয়েছে ৫৯০ কোটি ডলার। সুতরাং গত ১১ বছরে মোট পাচার হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে যার মূল্যমান ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত ১১ বছরে যে পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে তা দিয়ে হরহামেশাই বাংলাদেশের দুই দফা জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা সম্ভব। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, অন্য সব দেশের অর্থপাচারের তথ্য পাওয়া যায় ২০১৭ সাল পর্যন্ত কিন্তু বাংলাদেশের সর্বশেষ তথ্য ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কেননা পরের দুই বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য জাতিসংঘকে দেয়নি। জিএফআই’র আরো তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে যার পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গড় অর্থপাচারের হিসাবে ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩তম। অর্থপাচারের টাকার প্রায় বড় একটি অংশ পুঞ্জীভূত হয় সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংকে। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সের কিছু রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে রাখেন। পরবর্তীকালে সেই তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এরপরই ১৯৩৪ সালে সুইজারল্যান্ড ‘সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে। উক্ত আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের তথ্য সুইস ব্যাংক প্রকাশ করতে পারবে না। এরপর থেকেই সুইস ব্যাংকগুলোর গোপন হিসাবে অর্থ রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে ত্রিশের দশকের শেষদিকে জার্মানিতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করলে ইহুদিরা তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখা শুরু করে। সুইস ব্যাংকের রমরমা ব্যবসা তখন থেকেই মূলত শুরু হয়। (সূত্র : প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০২০)। সুইস ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা। তারপর পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স ও হংকং। বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থান একমাত্র ভারতের। ভারতের অবস্থান ৭৭তম। অন্যদিকে পাকিস্তানের অবস্থান ৯৯তম, নেপাল ১১৮তম, শ্রীলঙ্কা ১৪৮তম, মিয়ানমার ১৮৬তম এবং ভুটান ১৯৬তম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা দেশের তালিকায় ভারত ছিল ৩৭তম। আর এখন তারা ৭৭তম। ২০০৫ সালে ভারতের নাগরিকদের রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। একই সময় বাংলাদেশের ছিল ৮৬৩ কোটি টাকা। তবে সর্বশেষ ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের আছে ৫ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভারতীয় নাগরিকদের আছে ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। সম্প্রতি কর ফাঁকি, অপরাধমূলক ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে হচ্ছে। একইসাথে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী, কয়েক বছর যাবত তারা শুধু কোনো নির্দিষ্ট দেশের শুধু জমাকৃত অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নাম প্রকাশে এখন অবধি অনিচ্ছুক। তবে আশার দিক হলো, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বেশকিছু দেশ বিশেষ একটি চুক্তি করেছে। ‘স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় কাঠামো’ এই চুক্তি ভারত করেছে ২০১৬ সালে। ফলে ২০১৯ সাল থেকে ভারত তথ্যও পেতে শুরু করেছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুইস ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ রেখেছে, তার বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে ভারত এখন তা জানতে পারবে। ফলে এখন সুইস ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ফেলছেন ভারতীয়রা। তবে বাংলাদেশ সরকারকে সংশ্লিষ্ট চুক্তি বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

বর্তমানে আলোচিত কিছু অর্থপাচার কাণ্ড হলো- এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের নামে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ২২৩ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে যুবলীগ নেতা সম্রাটের বিরুদ্ধে। এছাড়া খালেদ মাহমুদ, জিকে শামীম, সাহেদ, সেলিম প্রধান বা গোল্ডেন মনিরের নামে কোটি কোটি টাকা অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। আর এসব ঘটনা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ ও অভিশাপ তা আজ আমরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করছি।

অর্থপাচারের নেপথ্যে যেসব কারণ বিদ্যমান- বিভিন্ন দেশে অবৈধ টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ মানসিকতা, বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তোলা, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা, সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎচিন্তা প্রভৃতি অন্যতম। কানাডার বেগমপাড়া বেশি আলোচনায় এলেও যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ভারত ও থাইল্যান্ডে বহুলাংশে অর্থপাচার হচ্ছে। অর্থপাচার রোধে যে আইন দরকার তা বাংলাদেশে আছে, যা নেই তা হলো আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ ধারামতে, ‘কোনো ব্যক্তি মানিলন্ডারিং অপরাধ করলে বা অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করলে তিনি কমপক্ষে ৪ বছর এবং সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ড হবে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত, এ দুয়ের মধ্যে যেটা অধিক। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এরূপ কাজ করে, তাহলে আগের দণ্ডই থাকবে তবে অর্থদণ্ড হবে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত, এ দুয়ের মধ্যে যেটা অধিক।’ একই আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে যদি তার অর্থের উৎস বা হিসাব সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

অর্থপাচারের তদন্ত সাধারণত দুদক করে থাকেন। এক্ষেত্রে দুদককে আরো বেশি শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। কেননা দুদক প্রকাশ্যে যতই সঠিক কথা বলুক না কেন, প্রভাবশালী কারো বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে এমন উদাহরণ নগণ্য। দেশ থেকে বিনিয়োগ না হয়ে যদি এভাবে অর্থ পাচার হতে থাকে তাহলে দেশ শূন্য ঝুড়িতে পরিণত হবে। আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হলে সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। বাস্তবে রূপ নেবে না। মনে রাখতে হবে, পাচারকারীরা শুধু দেশ, জাতি বা সমাজের শত্রু না। বরং এরা রাষ্ট্রের জন্য করোনা ভাইরাস। সর্বোপরি অর্থ পাচার রোধে চাই একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা দেশবাসীর সম্মিলিত প্রত্যাশা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads