মানবতার অনন্য নজির

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

মানবতার অনন্য নজির

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

‘পিতা-মাতার আদর জানি না কেমন, তবে পেট্রেসিয়া ম্যাম আমাকে যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করেছেন তাতে কখনো মনে হয়নি আমার বাবা-মা নেই। লেখাপড়া থেকে শুরু করে যখন যা প্রয়োজন তিনি তখন তাই দিচ্ছেন।’ খুব আকুতি নিয়ে ছল ছল আঁখিতে উচ্ছ্বাসভরে কথাগুলো বলল চোদ্দ কিংবা পনের বছরের মেয়ে নিপা আক্তার। জন্মদাতা পিতা-মাতার কথা সে বলতে পারে না। এমনকি জানেও না কে তার বাবা-মা। মাত্র দু’বছর বয়সে তাকে গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশু পল্লী প্লাসে রেখে যায় কোনো একজন। শুধু নিপা নয়, এখানে বর্তমানে ৩৪২ অনাথ ছেলেমেয়েকে লালন-পালন করা হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই জানে না কে তাদের বাবা-মা। ঠিক কী ভুলের কারণে তারা তাদের জন্মদাতা মাতাপিতার আদর থেকে বঞ্চিত এটিও হয়তো তারা জানে না। তারা অবশ্য জানতে চায়ও না। বাবা-মা থাকলে কীভাবে আদর করত এটি হয়তো তারা জানে না। এই প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো কিছুর অভাব বোধ করতে দেয়নি। ঠিক মা-বাবার মতোই সবাইকে আগলে রেখেছে। বরং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যাবে মা-বাবা সন্তানের জন্যও অনেক সময় শত ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারে না। স্বাদ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। কিন্তু শিশু পল্লী প্লাস খুব যত্ন করেই অসহায় সন্তান ও স্বামীহারা নারীদের সব প্রয়োজনই কমবেশি মেটানোর চেষ্টা করছে। লেখাপড়া থেকে শুরু করে অসুস্থতায় সার্বক্ষণিক ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা প্রদান। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলারও যথেষ্ট সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও ছেলেমেয়েদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে যাতে কর্মজীবনে তাদের হোঁচট খেতে না হয়।

১৯৮৯ সালে অসহায়দের এ আশ্রয়স্থলটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ নাগরিক পেট্রেসিয়া অ্যান ভিভিয়ানা কার। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫৫৯ মেয়ে ১৪৮০ ছেলে এবং ১ হাজার সহায়সম্বলহীন অসহায় নারীকে লালনপালন করেছেন। যাদের সবাই এখন আত্মনির্ভরশীল এবং দেশের কল্যাণে সার্বিকভাবে কাজ করছে। আর এমন একটি মহতী কাজ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মনের মাধুরী মিশিয়ে সযত্নে করে যাচ্ছেন পেট্রেসিয়া কার। যদিও মানবিক ও অসামান্য এ মহৎ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের দেশের সরকার ইতোমধ্যে ব্রিটিশ নাগরিক পেট্রেসিয়া অ্যান ভিভিয়ানা কারকে সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছেন। নাগরিকত্ব পেয়ে পেট্রিসিয়া কার নিঃসন্দেহে যথেষ্ট আনন্দিত। আমরাও তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে গর্বিত। একজন ব্রিটিশ নাগরিক যখন মহান এ ভাষার মাসে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে ‘আমি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি’- তখন সত্যিই আনন্দে চোখে জল চলে আসে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এর চেয়ে আর গর্বের কী হতে পারে!

পেট্রেসিয়া কারকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয় মানবতার মূর্ত প্রতীক জর্জ হ্যারিসনের কথা। একজন বিদেশি হয়েও যিনি ১৯৭১ সালে বিভীষিকাময় রক্তাক্ত বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে বাঁচাতে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়োজন করেছিলেন। তিনি অস্ত্র হাতে নিয়ে হয়তো যুদ্ধ করেননি, কিন্তু গিটার আর গান দিয়ে যে যুদ্ধ করেছিলেন তা বাংলাদেশ অনন্তকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে। আজকে পেট্রেসিয়া কার যেটি করছেন সেটিও কিন্তু মানবতার এক অনন্য নজির। খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে চারিদিকে সন্ত্রাস, মাদক, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধসহ নানা ভয়ানক সব কার্যকলাপের দৃশ্য। আর এসব অপরাধের বেশির ভাগই সংগঠিত হয় পরিবারহীন হতাশাগ্রস্ত অভাবী মানুষদের দ্বারা। একটি শিশু যখন আশ্রয়হীন বা পরিবার ছাড়া বড় হতে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে কঠোরতার জন্ম নেয়। সমাজের বাস্তবতা ধীরে ধীরে একটি কোমল হূদয়কে শক্ত পাথরে রূপ দেয়। আর তখন কোনো অপরাধই তার কাছে অন্যায় কিছু মনে হয় না। সেই দিক থেকে পেট্রেসিয়া কার একেবারে আমাদের দেশের মূল সমস্যা নিরসনেই কাজ করছে বলে মনে করি। পরিবারহীন ওই সমস্ত শিশুকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে পরিবারের আদর ভালোবাসা দিয়ে ধীরে ধীরে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভাবনাময়ী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। যে অনাথ সন্তানটির নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ছিল ঠিক সেই সন্তানটিকেই এখান থেকে আদর্শবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের চেয়ে আমাদের নিজেদের দেশের লোকেরাই আমাদের বেশি ক্ষতি করেছে। ঠিক এখনো পাকিস্তানিদের সেই দোসররা বিভিন্নভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতি করেতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি সেখানে পেট্রেসিয়া কারের মতো বিদেশি মহৎ প্রাণ একজন মানুষ আমার দেশকে ভালোবেসে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের মতো বৃহৎ সমাধানে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। কাজেই এমন একজন মহীয়সী নারীকে স্যালুট জানাতেই হয়। তবে সরকারকে শুধু নাগরিকত্ব প্রদানেই দায়সারা না হয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads