মুফতি উবায়দুল হক খান
ভাষা পৃথিবীতে অনেক। কয়েক সহস্র। কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন ভাষা আত্মাকে প্রশান্তি দান করে? কোন ভাষা হূদয়কে আবেগাপ্লুত করে? কোন ভাষা এক হূদয় থেকে অন্য হূদয়ে ভালোবাসা পৌঁছে দেয়? কোন ভাষা হূদয়ে আনন্দ দান করে? কোন ভাষা আহত হূদয়ের বেদনা উপশম করে? তাহলে উত্তর আসবে মাতৃভাষা। যে ভাষা ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মাতৃক্রোড়ে প্রথম নবজাতক শুনে থাকে। আর মায়ের মুখে শুনতে শুনতে এবং অনুকরণ করে বলতে বলতে যে ভাষা নিজের ভাষা হয়ে যায়, সে ভাষাই মাতৃভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষা রয়েছে। তবে প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষা একটিই। কারণ মায়ের কাছ থেকে আমরা প্রত্যেকে একটি ভাষা শিখি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আর ইংরেজদের মাতৃভাষা ইংরেজি। আরবদের মাতৃভাষা আরবি। প্রতিটি ভাষাই কিছুসংখ্যক বা বহুসংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা। যার যার মাতৃভাষা তার তার প্রিয় ভাষা। হূদয়ের ভাষা। অন্তরের ভাষা।
আমরা বাংলাদেশি। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। এ ভাষায়ই মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করি। কাজেই আমরা বাংলাভাষী। শিশুকালে এ ভাষাতেই আমরা কথা বলা শুরু করেছি। এ ভাষাতেই আমরা আমাদের যাবতীয় আবেগ-আহ্লাদ, আনন্দ-বেদনার প্রকাশ ঘটিয়েছি। এ ভাষায় লিখে, পড়ে ও কথা বলে আমরা যতটুকু আনন্দবোধ করি, অন্য যে কোনো ভাষাতে ততটুকু বোধ করি না। তা সম্ভবও নয়। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তার (আল্লাহর) নির্দশনাবলির মধ্য থেকে অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’ এ জন্যই মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেককেই স্ব স্ব গোত্রীয় ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। যাতে উম্মতেরা তাদের কথা বুঝতে পারেন। আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেহেতু তাঁর ভাষা ছিল আরবি। অনুরূপভাবে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ওপর তাওরাত হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল সুরিয়ানী ভাষায় এবং হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর যাবুর ইউনানী ভাষায় নাজিল হয়েছে। আর এসবের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য একটিই, তাহলো যেন তিনি তাঁর মনের ভাব উম্মতের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারেন। বিশদভাবে ব্যক্ত করতে পারেন তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের কথা।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ সর্বত্রই চরম উপেক্ষা আর অবজ্ঞার শিকার। যে ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের কোনো এক উজ্জ্বল দিনে দেশের অসংখ্য কৃতী সন্তান জীবন দিল, বুকের তাজা খুন ঢেলে দিল; সে দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন। তবে সে দিনটি আজ পালিত হচ্ছে ৮ ফাল্গুনের পরিবর্তে ২১ ফেব্রুয়ারিতে। আর আনন্দচিত্তে গাওয়া হচ্ছে-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি?
যেই বাঙালিদের আত্মত্যাগের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল বাংলাভাষা, আজ সেই বাঙালিদের বংশধারাই আপন মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করে ভাষা দিবস হিসেবে। জানি না এতে তাদের কী উদ্দেশ্য? কিইবা তাদের আশা। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ স্কুলপড়ুয়ারা দু চারটি ইংরেজি শব্দ শিখেই নিজেকে অনেক কিছু মনে করে এবং ক্ষেত্রবিশেষ নিজ মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলাকে অপমানের বিষয় বলে মনে করে। আবার তাদের অধিকাংশরা ভালোভাবে বাংলা বারোটি মাসের নামও বলতে পারে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো আগামী কয়েক বৎসর পরের প্রজন্মরা বাংলা মাসের নামগুলো দুর্বোধ্য কিছু মনে করে ডাস্টবিনের বস্তু হিসেবে পরিণত করবে।
আমি একথা বলছি না, ইংরেজি শিক্ষা বন্ধ করে দিতে হবে। আর একথাও মনে করবেন না, আমি ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করছি। বরং আমার কথার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যেন ইংরেজি বা অন্য যে কোনো ভাষায় যেন এতো অধিক পরিমাণে লিপ্ত হয়ে না পড়ি, যাতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অবহেলিত হয়। উপেক্ষার শিকার হয়। নতুবা কেউ যদি ভালো কোনো উদ্দেশ্যে ইংরেজি শিখে, অন্য কোনো ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে; তবে সেটা অন্যায় নয়; বরং যে তাকে খারাপ বলবে সেই অন্যায়কারী ও খারাপ হিসেবে সুধীমহলে চিহ্নিত হবে। অতএব, বর্তমান সময়ে দীনের জন্য, ইসলামের হেফাজতের স্বার্থে, বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসারকে আরো ব্যাপকতাদানের স্বার্থে বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্য থেকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দোষের কিছু নয়।
মূল কথা হলো, ভিনদেশি কোনো ভাষা শেখা নিষেধ নয়। তবে শর্ত হলো স্বীয় মাতৃভাষার যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে। মাতৃভাষার গুরত্ব তাকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে। তবেই তাদের অন্তরে দেশাত্মবোধ থাকবে। স্বজাতির প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসা থাকবে। তারা অবশ্যই মাতৃভাষাকে যথোওপাযুক্ত মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন। এটাই সুস্থ মস্তিষ্কের দাবি। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় বিপর্যয় অনিবার্য। বস্তুত মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা ও অবহেলা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আত্মহননেরই নামান্তর। আর যারা স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করে তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী। আমাদের জাতীয় জীবনকে শক্তিশালী করেত হলে, মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হলে, পারস্পরিক একতার বন্ধনকে নিবিড় থেকে নিবিড়তর করতে হলে মাতৃভাষায় গুরত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।
লেখক : মুহাদ্দিস ও সহকারী শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর