মহাসড়কে বাড়বে চাপ

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শঙ্কা

মহাসড়কে বাড়বে চাপ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৯ জুলাই, ২০১৯

চলমান বন্যায় রেল ও সড়কপথ বেহাল দশায়। সারা দেশে রেলওয়ের ৭টি রুটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার রেলপথ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মহাসড়ক এবং ৪৫০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

এসব নিয়েই আসন্ন ঈদুল আজহায় ঘরমুখো মানুষ ভোগান্তিতে পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোরবানির ঈদের আগে ওইসব পথ সম্পূর্ণ মেরামত করার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এ জন্য সরকারও ঠিক দায়ী নয়। বন্যা পুরোপুরি না গেলে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।

সামগ্রিক অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ঈদযাত্রা স্বাভাবিক গতি হারাবে। রেলপথ পুরোপুরি ব্যবহার করা যাবে না ঘরমুখো মানুষ পরিবহনে। এতে সড়কপথে চাপ পড়বে; বাড়বে ভোগান্তি।

এদিকে সড়ক বিভাগ জানায়, নানা কারণে ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার সড়ক এমনিতেই বেহাল দশায়। তারপর ভারী বর্ষা ও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের। এসব সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। ঈদুল আজহায় যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে এই জোড়াতালির সড়ক ঘরমুখো মানুষকে কতটা স্বস্তি দেবে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যায় দেশের ১৮টি জেলার ৪৫০ কিলোমিটার সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সওজ সূত্র বলছে, নতুন নির্মাণ করা সড়কের বয়সসীমা গড়ে ২০ বছর। নতুন সড়কে পাঁচ বছর সেভাবে হাত দেওয়ারই কথা নয়। পুরনো সড়ক পুনঃনির্মাণ হলে ১০ বছর টিকে থাকার কথা। আর বড় ধরনের মেরামতের পর সড়ক তিন থেকে পাঁচ বছর টিকে থাকে।

সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সওজের অধীনে থাকা সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, মেরামত প্রশস্তকরণে ৫৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ সময় ৫ হাজার ১৭৯ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত ও মজবুত করা হয়েছে। ১৪ হাজার ৯১৯ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন মেরামত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর তা চালু হয়েছে দুই বছর আগে। তবে এখনই ওই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান উঁচু-নিচু হয়ে গেছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। একই অবস্থা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত অংশ।

অন্যদিকে সওজের কর্মকর্তারা জানান, তিন কারণে সড়ক আশানুরূপ টিকছে না। ১. অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহনের চলাচল। ২. নির্মাণ ও মেরামত কাজে দীর্ঘসূত্রতা ও ৩. নিম্নমানের নির্মাণ ও মেরামত।

সওজের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব সময় সড়কের দুরবস্থার জন্যই যানজট বা দুর্ভোগ হয়, এমন নয়। কিছু কিছু স্থানে অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভোগ হয়। কোথাও কোথাও সরু সেতুর কারণে যানজট হয়। যেমন, গত ঈদুল ফিতরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর আগে-পরে। কারণ, ঢাকা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক এখন চার লেনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতু দুই লেনের। ফলে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চওড়া সড়ক ধরে গিয়ে সরু সেতুতে আটকে যাচ্ছে। এরপর সিরাজগঞ্জে নলকা ও ধোপাকান্দি সেতু দুটি সরু। জরাজীর্ণ হওয়ায় যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। এবার এলেঙ্গার আগে কিছু অংশ বেশ ভাঙাচোরা। ধোপাকান্দি ও নলকা সেতুও আগের মতোই নাজুক। ফলে যানবাহনের চাপ পড়লে এবারো যানজটের আশঙ্কা আছে।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঈদের আগে কর্মকর্তাদের সময় বেঁধে দেওয়ার যে রেওয়াজ চালু হয়েছে, এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। সিংহভাগ অর্থই লুটপাট ও অপচয় হয়। আর জোড়াতালির সামান্য যে কাজ হয়, যানবাহনের চাকার সঙ্গে তা ভেসে যায়। সারা বছর একতালে মেরামত করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, সওজে বড় প্রকল্পে মনোযোগ বেশি বলে মেরামতে মনোযোগ একটু কম। আর মেরামত কাজটাও হয় অর্থবছরের শেষদিকে, বর্ষা মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে মেরামত টিকবে না-এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, মেরামত করতে হবে শুষ্ক মৌসুমে, ভালোভাবে করতে হবে। আর নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে উপকরণ ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, সড়কের পিচ করার ক্ষেত্রে মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা যায়। এই বিটুমিন ব্যবহার করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে উঁচু-নিচু হয়ে গেছে, তা হয়তো হতো না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, একই সমস্যা বারবার হওয়ার অর্থই হলো, এর সমাধানে কোনো বিজ্ঞান নেই। সড়কে মেরামত, ভেঙে যাওয়া আবার মেরামত-এই চক্র ভুল পদ্ধতির ফল। তিনি বলেন, গতবার ঈদে যেসব স্থানে এবং যেসব সমস্যা হয়েছে, তা চিহ্নিত করে গত এক বছরে তা সমাধান করে ফেলার কথা। বলা হচ্ছে, বন্যা, বৃষ্টি আর অতিরিক্ত মালবাহী যান সড়কের ক্ষতি করছে। কিন্তু বাংলাদেশই তো একমাত্র বন্যা-বৃষ্টির দেশ নয়।

সওজের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী না হলে ঈদের আগে সড়ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আশা করছি, কোনো দুর্ভোগ হবে না। তিনি বলেন, সড়কের বড় শত্রু অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহন। এ ছাড়া যানবাহন চলাচলের যে হিসাব ধরে সড়ক নির্মাণ বা মেরামত করা হয় তা দ্রুতই ছাড়িয়ে যায়। এ জন্য নির্মাণ ও মেরামতের পর সড়ক বেশি ভাঙে।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান বলেন, রেলপথের যেসব স্থান বন্যার কারণে ধসে গেছে, সেসব স্থান সচল করার জন্য কাজ চলছে। আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যে গাইবান্ধার বাদিয়াখালীসহ সব রেলপথ সচল করা হবে। তিনি বলেন, ঈদের আগেই সব এলাকার মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরতে পারে সে জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে কোনো কারণে রেলপথ স্বাভাবিক না হওয়া তাহলে সড়কপথে বেড়ে চাপ। আর তখনই নেমে আসবে ঘরেফেরা মানুষের মহাদুর্ভোগ।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক আসন্ন ঈদুল আজহার আগেই সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, দেশের জেলা-উপজেলায় বন্যায় যেসব রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা ঈদের অন্তত এক সপ্তাহ আগেই সংস্কার শেষ করা হবে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে, এই কমিটি রাস্তাঘাটগুলোর সংস্কারকাজ তদারকি করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads